বাংলাদেশের কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে কৃষিশিক্ষার গুরুত্ব

কৃষিশিক্ষা কৃষকদের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলেছবি: ফ্রিপিক

কৃষি শব্দের ব্যাপক অর্থে বোঝায়—জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন; গবাদিপশু উৎপাদন ও পালন; মৎস্য চাষ, ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রম। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যার অর্থনীতি ও জনজীবনের এক বিশাল অংশ কৃষিনির্ভর। আবহমানকাল ধরে এ দেশের কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সোনার ফসল ফলিয়ে আসছেন। তবে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় এবং উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে প্রায়ই তাঁরা তাঁদের শ্রমের ন্যায্য ফল থেকে বঞ্চিত হন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে কৃষিশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষিশিক্ষা শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করে না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

কৃষিশিক্ষার অর্থনৈতিক প্রভাব  
কৃষিশিক্ষা কৃষকদের আধুনিক কৃষিপদ্ধতি, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার, শস্য বহুমুখীকরণ, সেচ ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে জ্ঞান প্রদান করে। এর ফলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিম্নে বর্ণিতভাবে বিবিধ ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন করে।

১. উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা: কৃষিশিক্ষা কৃষকদের আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক চাষাবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। যার ফলে তাঁরা তাঁদের জমি, সার, বীজ, পানি ইত্যাদি কৃষি উপাদানগুলো অধিক কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারেন। বিশেষত উচ্চ ফলনশীল জাত, রোগপ্রতিরোধক্ষম জাত এবং জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কৃষকদের উৎপাদনশীলতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষক যদি সময়মতো উচ্চ ফলনশীল ধান বা গমের জাত ব্যবহার করেন, সেচ ও সার ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট জ্ঞান প্রয়োগ করেন, তবে একই পরিমাণ জমিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ফলন লাভ করতে পারেন।

ফলন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পায়, যা তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হয় এবং দেশে খাদ্য সরবরাহ বাড়ে, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকে এবং দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কৃষিশিক্ষা কৃষকদের কেবল উৎপাদনপদ্ধতি নয়, বরং সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ এবং মূল্য সংযোজন প্রযুক্তি সম্পর্কেও দক্ষ করে তোলে; যা সামগ্রিকভাবে কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখে। একবিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও ক্রমাগত বাড়ছে। এই অবস্থায় কৃষিশিক্ষার গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। টেকসই খাদ্য উৎপাদন, মাটি ও পানির যথাযথ ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবনের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের কৃষিশিক্ষাকে আরও আধুনিক, বাস্তবমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। তাই খাদ্যনিরাপত্তা ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষিশিক্ষার গুরুত্ব এখন শুধু প্রয়োজন নয়, বরং অপরিহার্য।

২. আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন: উন্নত কৃষি কৌশল প্রয়োগ যেমন ড্রোন ও হাইটেক ক্যামেরা ব্যবহার করে ফসলের মধ্যে থাকা আগাছা বা রোগবালাই চিহ্নিত করে উপযুক্ত বালাইনাশক প্রয়োগ, স্মার্ট অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে সময়মতো ও ফসলে পরিমিত পানি প্রয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষক যখন অধিক ফসল অর্জন করতে সক্ষম হন, তখন তাঁদের উৎপাদন খরচ কমে এবং আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত আয় কেবল তাঁদের খাদ্য চাহিদা মেটায় না, বরং সন্তানদের উন্নত শিক্ষা, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আবাসন এবং দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ বহনে সহায়ক হয়।

আয়ের এই ইতিবাচক পরিবর্তন কৃষক পরিবারে আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং তাঁদের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে ছোট খামারকে মাঝারি খামারে রূপান্তর করতে পারে, কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ গড়ে তুলতে পারে; যা আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বিশেষত প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদের জন্য কৃষিশিক্ষা একটি শক্তিশালী দারিদ্র্য নিরসন হাতিয়ার। কারণ, তাঁরা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লাভজনক ফসল চাষ, পশুপালন, মৎস্য চাষ ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে দক্ষতা অর্জন করেন। এর ফলে শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আয় বৃদ্ধি নয়, বরং গোটা গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আসে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজাত পণ্যের চাহিদা, পরিবহন, বিপণন ও বাজারব্যবস্থা বিস্তৃত হয় এবং পরোক্ষভাবে আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। অতএব, কৃষিশিক্ষা আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের একটি কার্যকর ও টেকসই মাধ্যম, যা গ্রামীণ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তোলে।

৩. বাজার সম্পর্ক ও মূল্য সংযোজন: আধুনিক কৃষিশিক্ষা কেবল ফসল উৎপাদনের কৌশল শেখায় না, বরং এর পরবর্তী ধাপ যেমন বাজার বিশ্লেষণ, বিপণন কৌশল, মান নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রয়ের দক্ষতাও অর্জনের সুযোগ করে দেয়। কৃষকেরা যখন জানতে পারেন কোন পণ্য কখন, কোথায় এবং কীভাবে বাজারজাত করলে সর্বোচ্চ মূল্য পাওয়া যায়, তখন তাঁরা আর কেবলমাত্র উৎপাদক হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেন না, তাঁরা রূপান্তরিত হন একজন দক্ষ উদ্যোক্তায়। এই জ্ঞান তাঁদের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা করে এবং নিজের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। তা ছাড়া তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত শস্য থেকে বেশি মূল্যের দ্রব্যাদি তৈরি করে বাজারজাত করতে শেখেন।

উদাহরণস্বরূপ, টমেটো, কলা বা দুধের মতো পচনশীল পণ্য যদি উপযুক্তভাবে প্রক্রিয়াজাত করে সস, চিপস বা দই হিসেবে বাজারজাত করা যায়, তবে তার মূল্য অনেক গুণ বাড়ে এবং সংরক্ষণও সহজ হয়। কৃষিশিক্ষা কৃষকদের এমন প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি ও মূল্য সংযোজনের কৌশল শেখায়, যার ফলে একই পণ্য থেকে তাঁরা বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে পারেন। অনেক সময় কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও মান ও প্যাকেজিং–সংক্রান্ত জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে; যা কৃষিশিক্ষার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। এ ছাড়া, কৃষিশিক্ষা ডিজিটাল মার্কেটিং, অনলাইন বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম যেমন ই-কমার্স, কৃষিপণ্য মেলা এবং কন্ট্রাক্ট ফার্মিং সম্পর্কেও সচেতনতা সৃষ্টি করে। যার ফলে কৃষকেরা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্রেতা গোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। এইভাবে কৃষিশিক্ষা কৃষকদের শুধু উৎপাদক নয়, বরং একটি সফল কৃষিভিত্তিক ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলে। তখন সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিতে গতি আসে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও সুদৃঢ় হয়।

৪. সম্পদের সদ্ব্যবহার ও পরিবেশ সংরক্ষণ: কৃষিশিক্ষা কৃষকদের ভূমি, পানি, বায়ু, জৈব পদার্থ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ও টেকসই ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন করে তোলে। এটা কৃষকদের এমনভাবে চাষাবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করে, যাতে উৎপাদন বাড়ে কিন্তু পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। মাটির সঠিক স্বাস্থ্য নিরূপণ, মাটির উর্বরতা বজায় রাখা, সারের সঠিক মাত্রা ব্যবহার, জৈব সার ও কম্পোস্ট প্রয়োগ এবং কীটনাশকের পরিবেশবান্ধব ব্যবহারের কৌশল, কৃষিশিক্ষার মাধ্যমে শেখানো হয়। এর ফলে জমির উর্বরতা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং পানিদূষণ ও ভূমিদূষণ কমে যায়। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, লবণাক্ততা ও অনিয়মিত ঋতুচক্র কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিশিক্ষা কৃষকদের এসব পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও অভিযোজনমূলক কৌশল সম্পর্কে অবগত করে। যেমন খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল জাত নির্বাচন, শুষ্ক মৌসুমে পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তির (যেমন ড্রিপ ও স্প্রিংকলার সেচ) ব্যবহার, মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য মালচিং পদ্ধতি এবং জলাধারা বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কৌশল—এসব বিষয়ে জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

এ ছাড়া কৃষিশিক্ষা পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চা যেমন জৈব কৃষি, ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট, কনজারভেশন অ্যাগ্রিকালচার এবং অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি প্রবর্তনে সহায়তা করে; যা জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষকেরা যখন এমন জ্ঞান ব্যবহার করে টেকসই চাষাবাদে মনোনিবেশ করে তখন প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ হয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।

কৃষিশিক্ষার সামাজিক প্রভাব
কৃষিশিক্ষায় সামাজিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং একটি টেকসই গ্রামীণ সমাজ গঠনে অপরিহার্য।

১. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: কৃষিশিক্ষা কৃষকদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে তাঁদের আয় বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়তা করে। যখন একজন কৃষক আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে অধিক ফসল উৎপাদনে সক্ষম হন, তখন তাঁর আয় বাড়ে এবং এই বর্ধিত আয় কৃষকদের শুধু আর্থিকভাবে সচ্ছল করে না, বরং তাঁদের পরিবারের সার্বিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আয় বৃদ্ধি পেলে কৃষকেরা পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সক্ষম হন; যা তাঁদের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করে। কৃষিশিক্ষা কৃষকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও সঠিক পুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কেও অবগত করে। যার ফলে তাঁরা নিজে যেমন নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করেন, তেমনি বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে পুরো সমাজের উপকারে আসেন। একই সঙ্গে বাড়ি সংস্কার, উন্নত আবাসন, নিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করার সক্ষমতা অর্জন করেন।

কৃষিশিক্ষার মাধ্যমে নারী ও যুবকদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পায়। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানো, উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা সুবিধা অর্জনও তখন সম্ভব হয়। পরোক্ষভাবে, এই উন্নয়ন গ্রামীণ সমাজে একধরনের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে। যেখানে সবাই নিজেদের জীবনমান উন্নয়নে সচেষ্ট হয় বলে গ্রামীণ অঞ্চলে দারিদ্র্য কমে, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায় এবং মানব উন্নয়ন সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়।

২. শিক্ষার প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধি: কৃষিশিক্ষা কৃষকদের মধ্যে শুধু আধুনিক চাষাবাদের জ্ঞানই বৃদ্ধি করে না, বরং তাঁদের মানসিকতায় একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। একজন কৃষক যখন কৃষিশিক্ষার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে জ্ঞানই উন্নতির মূল চাবিকাঠি। ফলে তিনি নিজের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহী হন এবং তাদের উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে নিতে সচেষ্ট থাকেন। শিক্ষিত কৃষকেরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ গঠনে বিনিয়োগকে একটি দীর্ঘমেয়াদি লাভজনক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করেন। এর ফলে কৃষিপ্রধান গ্রামীণ সমাজে শিক্ষা বিস্তারের হার ক্রমে বাড়তে থাকে। এ ছাড়া কৃষিশিক্ষা কৃষকদের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন বায়োটেকনোলজি, স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার, জলবায়ু সহনশীল ফসল, পরিবেশবান্ধব কীটনাশক ইত্যাদি গ্রহণের মানসিকতা তৈরি করে। এই প্রযুক্তি গ্রহণের মানসিকতা শুধু কৃষিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তারা অন্যান্য ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁদের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারা ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।

কৃষিশিক্ষার আরেকটি বড় প্রভাব হলো সামাজিক সচেতনতার উন্নয়ন। কৃষকেরা যখন জ্ঞান অর্জন করেন, তখন তাঁরা আত্মবিশ্বাস, কুসংস্কার ও প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে ধীরে ধীরে সরে আসেন। যেমন আগেকার দিনে অনেকেই বিশ্বাস করতেন নির্দিষ্ট গাছ কাটলে দুর্ভাগ্য আসে, বা নির্দিষ্ট রোগে ওঝার ঝাড়ফুঁক প্রয়োজন, ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষিত কৃষক এসবের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সমাধান খোঁজেন।

৩. নারীর ক্ষমতায়ন: বাংলাদেশে কৃষিব্যবস্থায় নারীর অবদান ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা অবমূল্যায়িত ও অদৃশ্য ছিল। বর্তমানে নারীরা বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, ফসল কাটাসহ বিভিন্ন ধাপে সক্রিয় অংশগ্রহণ করছেন। কৃষিশিক্ষা নারীদের এই ভূমিকাকে কেবল শ্রমনির্ভর নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত ও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতায় রূপান্তর করতে সাহায্য করে। নারীরা যখন আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, জৈব কৃষি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পশু পালন, মৎস্য চাষ, মৌ চাষ এবং বাড়িভিত্তিক উদ্যোক্তা কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ পান, তখন তাঁরা কৃষিকে একটি লাভজনক পেশায় পরিণত করতে সক্ষম হন। এই শিক্ষার ফলে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন এবং তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে তাঁরা নিজেদের আয়ের মাধ্যমে পারিবারিক ব্যয়, যেমন সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্যনিরাপত্তা ও সঞ্চয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

এভাবে নারীরা কেবল উপার্জনক্ষম সদস্য হিসেবেই নয়, বরং নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। নারীদের এই ক্ষমতায়ন শুধু পরিবারে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। কৃষিশিক্ষা তাঁদের সামাজিক স্বীকৃতি, মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে প্রান্তিক ও দরিদ্র পরিবারের নারীরা যখন কৃষি প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায় বা খামার গড়ে তোলেন, তখন তাঁদের জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও মেয়েদের ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করছে; যা ব্যবহার করে তাঁরা গবাদিপশু পালন, মাশরুম চাষ, মুরগি পালন, সবজি চাষ, মৌ চাষ, সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ইত্যাদি কৃষিকাজে অগ্রগতি সাধন করছেন। এ ছাড়া কৃষিশিক্ষা নারীদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগও সৃষ্টি করে, যেমন নারীকেন্দ্রিক কৃষক সংগঠন, সমবায় এবং স্থানীয় বাজারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাঁরা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেন। এতে নারীদের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও প্রতিফলিত হয়।

৪. গ্রামীণ উন্নয়ন ও অভিবাসন হ্রাস: কৃষিশিক্ষার বিস্তার গ্রামীণ উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। যখন কৃষকেরা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশবান্ধব চাষাবাদের জ্ঞান অর্জন করেন, তখন তাঁরা কৃষিকে একটি লাভজনক পেশায় পরিণত করতে সক্ষম হন। এর ফলে গ্রামের কৃষিজীবীরা তাঁদের জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারেন এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া গ্রামীণ এলাকায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যেমন কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ কার্যক্রম।

এসব কর্মসংস্থান যুবসমাজকে তাদের নিজ গ্রামে থেকেই জীবিকা নির্বাহের পথ দেখায়। ফলে শহরমুখী অভিবাসনের প্রবণতা কমে যায়, যা শহরাঞ্চলের ওপর অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ হ্রাস করে এবং নগর অবকাঠামোর ওপর বিরূপ প্রভাব কমায়। একই সঙ্গে শিক্ষিত ও দক্ষ কৃষকেরা গ্রামের অভ্যন্তরে থেকেই উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন এবং স্থানীয়ভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তাঁরা স্থানীয় তরুণদের জন্য আদর্শ হয়ে ওঠেন; যেটি আত্মনির্ভরশীলতা এবং উদ্যোক্তা গঠনে ভূমিকা রাখে।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
কৃষিশিক্ষা শুধু ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিই করে না, বরং কৃষকের সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই শিক্ষার পূর্ণ সুফল পেতে হলে আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দেশের অনেক অঞ্চলে এখনো পর্যাপ্ত কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এই সংকট আরও বেশি। উল্লেখ করা যেতে পারে, সরকারি ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মাত্র ৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিশিক্ষার সুযোগ রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

এ ছাড়া পাঠ্যক্রমে আধুনিক গবেষণা ও প্রায়োগিক শিক্ষার যথাযথ সমন্বয় না থাকায় শিক্ষার্থীরা বাস্তব ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে পড়েন। প্রশিক্ষিত ও যুগোপযোগী জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবও কৃষিশিক্ষার মান উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়। উপরন্তু, সাধারণ কৃষকদের কাছে সহজ ও বোধগম্যভাবে এই জ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কৃষিশিক্ষার অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা, নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান সম্ভব। প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে কৃষিশিক্ষাকে সহজলভ্য করে কৃষিবান্ধব করে তোলা সম্ভব। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব চ্যানেল, ই-লার্নিং কোর্স, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং কমিউনিটি রেডিওর স্থানীয় কৃষি তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষিবিষয়ক জ্ঞান সহজে ও দ্রুত কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়।

লেখক: কৃষিবিদ এবং উপাচার্য, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।