প্রযুক্তির দ্বিমুখী ছায়া: অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতার সুফল ও কুফল

সুবিধার পাশাপাশি অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা সমাজে এক নতুন ধরনের উদ্বেগ, একাকিত্ব, মানসিক ও শারীরিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছেছবি: ফ্রিপিক

একুশ শতাব্দীকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব দৃশ্যমান। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিটি কাজই কোনো না কোনোভাবে প্রযুক্তিনির্ভর। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), মেশিন লার্নিং, রোবোটিকস, বিগ ডেটা—এসব প্রযুক্তি জীবনকে করে তুলেছে অভাবনীয় সহজ ও গতিশীল। তবে এই সুবিধার পাশাপাশি অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা সমাজে এক নতুন ধরনের উদ্বেগ, একাকিত্ব, মানসিক ও শারীরিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে।

প্রযুক্তিনির্ভরতার ইতিবাচক দিক

দ্রুত ও সহজ যোগাযোগ: ইন্টারনেটের মাধ্যমে আজকের পৃথিবী হয়ে উঠেছে গ্লোবাল ভিলেজ। এক ক্লিকে যোগাযোগ সম্ভব পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৫ দশমিক ৫৬ থেকে ৫ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই–মেইল, ভিডিও কনফারেন্স—এসব মাধ্যম দিয়ে এখন অফিস, পরিবার, বন্ধুর সঙ্গে সংযুক্ত থাকা অত্যন্ত সহজ।

শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের নতুন দুয়ার: অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম যেমন কোর্সেরা, খান একাডেমি, উডেমি—এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জন্য জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অনলাইন ক্লাস, ভার্চ্যুয়াল পরীক্ষা, ডিজিটাল লার্নিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শিক্ষার্থীরা ইউটিউব, মোবাইল অ্যাপস, গুগল সার্চের মাধ্যমে সহজেই নতুন কিছু শিখতে পারছে।

স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও উন্নত: টেলিমেডিসিন ও অনলাইন স্বাস্থ্য পরামর্শ এখন অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে চিকিৎসা গ্রহণের হার ২০২১ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগী এখন ঘরে বসেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারছে, রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারছে।

কাজের গতি বৃদ্ধি ও পেশাগত সুবিধা: রিমোট জব, ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন ব্যবসা—এসব এখন প্রযুক্তির কল্যাণেই সম্ভব হচ্ছে। ক্লাউড কম্পিউটিং, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টুলস (যেমন ট্রেলো, স্ল্যাক, জুম) অফিসের কাজকে করেছে আরও দ্রুত ও সুশৃঙ্খল।

প্রযুক্তিনির্ভরতার নেতিবাচক দিক

মানবিক সম্পর্কের দূরত্ব: একই ঘরে থেকেও অনেকে আজকাল কথাবার্তা কম বলে, চোখ থাকে মুঠোফোনের স্ক্রিনে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষ দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় মুঠোফোনে কাটায়, যা পরিবার ও সামাজিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় মগ্ন হয়ে বাস্তব সম্পর্কগুলো আজ ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মানসিক সমস্যার উদ্ভব: প্রতিনিয়ত স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, মেরুদণ্ডের ব্যথা, মাথাব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি সমস্যা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি ৭ জনে ১ জন কিশোর মানসিক সমস্যায় ভুগছে, যার অন্যতম কারণ প্রযুক্তির অপব্যবহার। ভার্চ্যুয়াল গেম, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত আসক্তি শিশু-কিশোরদের আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্য চুরি: প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, সাইবার অপরাধ তত বাড়ছে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী সাইবার অপরাধে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ দশমিক ১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশেও ডিজিটাল লেনদেন, বিকাশ বা নগদ অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনা অহরহ ঘটছে। তথ্যের নিরাপত্তা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

কর্মসংস্থানে প্রযুক্তির প্রভাব: রোবোটিকস, অটোমেশন ও এআইয়ের ব্যাপক প্রসারে অনেক চাকরি আজ হুমকির মুখে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ৮৫ মিলিয়ন কর্মসংস্থান বিলুপ্ত হতে পারে, যদিও একই সঙ্গে ৯৭ মিলিয়ন নতুন ধরনের কাজ তৈরি হবে। এই রূপান্তর কম দক্ষ শ্রমিকদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সমাধানের পথ: প্রযুক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গঠন
প্রযুক্তিকে দোষারোপ না করে আমাদের উচিত সচেতনভাবে এর ব্যবহার শেখা। প্রযুক্তি যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ না করে, আমরা যেন প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করি।
দৈনন্দিন জীবনে স্ক্রিন টাইম নির্ধারণ করা
পরিবারের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানো
শিশুদের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সময়সীমা ও গাইডলাইন তৈরি করা
সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে শিক্ষিত হওয়া
স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রযুক্তি থেকে কিছুটা দূরে থাকা

এই অভ্যাসগুলো আমাদের জীবনকে প্রযুক্তিনির্ভরতার নেতিবাচক দিক থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, মেট্রোপলিটন ইউনির্ভাসিটি, সিলেট