ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সুবাদে আমি ইফতেখার মাহমুদের সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স, ক্যারিয়ার সার্ভিসেস ও ইন্টারন্যাশনাল অফিসের দায়িত্বে থাকায় সব ক্লাব কো-অর্ডিনেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হতো। ইফতেখার স্যার ছিলেন ডিবেট ক্লাবের কো-অর্ডিনেটর। এ ক্লাবের কাজের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রপাত।
ইফতেখার মাহমুদ এমন মানুষ ছিলেন, যিনি শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের সাধ্যমতো সবকিছু করতেন। ডিবেট ক্লাবের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে একাধিকবার দেখেছি, প্রতিযোগিতার দল নিবন্ধন ফি নিজ পকেট থেকে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠিয়ে দিতেন, পরে স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স অফিসে বিল পাঠাতেন। কাগজপত্র এমনভাবে গুছিয়ে দিতেন, যেন নতুন করে কোনো কিছুর প্রয়োজন না হয়। একবার ছুটির দিনে এফডিসিতে ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিংয়ে গিয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেট টিমের সঙ্গে। ছুটির দিনে ক্লাবের কাজে সময় দিয়েছি বলে তিনি ফেরার পথে বারবার ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন, এমন সৌজন্যবোধ সত্যিই বিরল। যদিও তা আমার কাজের অংশই ছিল।
আমরা প্রায় দুই বছর একই অফিস পরিবহন ব্যবহার করেছি। যাত্রাপথে ইফতেখার মাহমুদ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন—শিক্ষা, সমাজ, সাহিত্য, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ব্যক্তিক উন্নয়ন নিয়ে। কখনো সরাসরি আমার সঙ্গে, কখনো অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে। অনেক দিন বলতেন, ‘ফরহাদ, আজ ক্লাসের শিডিউলের জন্য সময় হলো না। চলেন, বাকি আলোচনা গাড়িতে বসে শেষ করি।’ সেই আলোচনা ছিল জ্ঞানের এক উন্মুক্ত পাঠশালা।
একবার উপাচার্য সহিদ আকতার স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক্লাব অ্যাক্টিভিটি গাইডলাইন’ তৈরি করার দায়িত্ব আমাদের দিলেন। ইফতেখার স্যার আহ্বায়ক, আমি সদস্যসচিব। ক্লাসের ব্যস্ততম শিডিউলের মধ্যেও তিনি ল্যাপটপ নিয়ে চলে আসতেন আমার অফিসে, সঙ্গে ২-৩ জন সদস্য। কমিটির অনেক সদস্য মিটিংয়ে এসে ইফতেখার স্যারকে জানাতেন, ‘স্যার, ক্লাস আছে। আজকে বেশি সময় দিতে পারব না।’ সেটা ছিল তাঁর প্রতি শিক্ষকদের গভীর শ্রদ্ধার প্রমাণ। গাইডলাইনটি শেষ করতে না পারলেও তাঁর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা আজও মনে গেঁথে আছে।
ইফতেখার মাহমুদের প্রভাব ছিল সর্বত্র। শুধু তাঁর বিভাগের নয়, অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও তাঁকে সমান ভালোবাসতেন। আতিক, মুন্না, মম, তানহা, জেমিমা—অসংখ্য শিক্ষার্থীর মুখে শুনেছি, ‘স্যারই আমাদের অনুপ্রেরণা। ইফতেখার মাহমুদ একজনই।’
দুই বছর ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে কাজ শেষে যখন বিদায় নিচ্ছি, শেষ কর্মদিবসে হঠাৎ ইফতেখার মাহমুদ ডিবেট ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে আমার অফিসে এলেন। স্মিত হাসিতে বললেন, ‘আমরা আপনাকে রাখতে পারছি না, তবে একটা ছোট্ট উপহার দিতে চাই।’ সবাইকে নিয়ে আমার অফিস রুমের বাইরে গিয়ে ভালো ছবি আসবে এমন জায়গা খুঁজে বের করে ছবি তুললেন। তারপর হাতে দিলেন শহীদ মিনারের সুন্দর একটি রেপ্লিকা। আমি তেমনটির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। পরে বুঝলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার তৈরিতে আমার সম্পৃক্ততার প্রতি তাঁর অভিব্যক্তির নিদর্শন হিসেবেই তিনি তা দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আগে তিনি আমার কাজকে স্বীকৃতি জানাতে ভোলেননি, যা এখনো আমাকে পুলকিত করে।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইস্টার্ন বন্ধুসভার কোনো এক পাঠচক্রে ইফতেখার মাহমুদ এসেছিলেন আলোচক হিসেবে। সে আসরে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেদিন তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কার্যক্রম ইস্টার্নে শুরু করার পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন। জানি না, তা পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছিল কি না।
আজ ইফতেখার মাহমুদের প্রয়াণে অসংখ্য স্মৃতি ফিরে আসে—সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখ, সেই বিনয়ী ব্যবহারে ভরা প্রেরণার গল্পগুলো। জীবনে তাঁর মতো একজন মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পাওয়া আমার সৌভাগ্য। জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে যতটুকু জেনেছি, চলে যাওয়ার পর জেনেছি অনেক বেশি।
ইফতেখার মাহমুদ যেন ওপারে ভালো থাকেন—দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে, তাঁর প্রিয় অনুজ ও শিক্ষার্থীদের সাফল্যে চিরকাল উজ্জ্বল, চিরকাল হাস্যোজ্জ্বল থাকুন।
সাধারণ সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা