টলমলে পুকুর থেকে ডোবা—এক হারানো শৈশবস্মৃতি
শৈশবের একটি অংশ কেটেছে মামাবাড়িতে। মায়ের চাকরির সুবাদে ঠাঁই হয়েছিল সেখানে। তখন আমার বয়স তিন কি চার হবে। বাড়িটি বেশ পুরোনো, শুনেছি নানার দাদা নাকি এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন। একদম শহরের মাঝেই। কিন্তু একবার বাড়ির ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে সহজেই শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
বাড়ির ভেতরটা অনেক শান্তিময়। বাড়ির প্রাঙ্গণে ছিল একটি কামরাঙাগাছ, কোনো দিন ওই গাছের কামরাঙা খাওয়ার ভাগ্য হয়নি। গাছটিতে শুধু ফুল-কুঁড়ি এসে ঝরে যেত, ফলের দেখা কোনো দিন পাওয়া যেত না। তখন বাড়িতে একটি পুকুরঘাট ছিল। পুকুরের পানি এতই টলমলে ছিল যে মাছদের ছন্দোবদ্ধ নৃত্য অনায়াসেই দেখা যেত। আমরা পূর্ণিমা রাতে পুকুরপাড়ে বসে আড্ডা দিতাম।
একদিন পুকুরপাড়ে একটি ঘর তোলা হলো, আমার খুশি দেখে কে! নতুন ঘর হয়েছে, তাও কিনা পুকুরের পাশে। মা ঘরের সামনে অল্প জায়গায় ছোট্ট করে একটা বাগান করেছিলেন। সেখানে ছিল অনেক রকম শাকসবজি। একদিন মা বাসায় ছিল না, সেই সুযোগে আমি বাগানের একমাত্র গাজরগাছটা উঠিয়ে ফেললাম! ভেবেছিলাম না জানি কত সুন্দর একটি গাজর হবে, কিন্তু একি! গাজরটা যে সাদা আর ছোট! এই দেখে আমার কান্না থামছিলই না!
আমরা যে ঘরে থাকতাম, তার সামনে ছিল অনেক সুন্দর একটি বারান্দা। প্রতিদিন সেখানে বসে হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলতাম।
রোজ সন্ধ্যায় নানাভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে যেতাম। মামাবাড়ি থেকে ২ মিনিট হাঁটা দূরেই ছিল মধুমতী নদীর পাড়। একদিন সেখানে বাঁশের সাঁকো হলো, রোজ বিকেলে যেতাম সেখানে। একদিন স্রোতের তোড়ে ভেঙে গেল চিরচেনা সাঁকো, যার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ চা খেতাম। নানাভাই আমাকে প্রতিদিন এদিক-সেদিক ঘুরতে নিয়ে যেতেন। এক পরিচিত রিকশাওয়ালা ছিল, প্রতিদিন ওনার রিকশায় ঘুরতাম। তিনি আমাকে রোজ রোজ টক-মিষ্টি লজেন্স, রিং চিপস কিনে দিতেন।
আমরা যে ঘরে থাকতাম, তার সামনে ছিল অনেক সুন্দর একটি বারান্দা। প্রতিদিন সেখানে বসে হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলতাম। ছোট মামা আমাকে আঙিনার সব গাছের নাম শিখাত। উঠানে অনেক রকম পাখি, বিড়াল, বেজি ইত্যাদি আসত। বাড়ির সব দরজা ছিল কাঠের, যা বড় কাঠের তক্তা দিয়ে আটকে রাখা হতো। দিনের বেলা বারান্দার দিকের দরজা খুলে দিতাম আর উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের অনেক পুরোনো একটি বোকাবাক্স ছিল। সেখানে প্রতি শুক্রবারে সিসিমপুর দেখতাম। গ্রীষ্মকালে আমি আর মামারা মিলে বাড়ির ছাদে উঠে আম-কাঁঠাল সংগ্রহ করতাম।
বাড়ির বড় ও একমাত্র সন্তান হওয়ায় অনেক সময় আমি খেলায় সঙ্গীহীনভাবে কাটিয়েছি, কিন্তু কেন যেন কোনো দিন একাকিত্বে ভুগিনি। মামা-মামি, নানাভাই-নানুমণিরা সব সময় আমাকে আগলে রেখেছিল। এরপর মায়ের ট্রান্সফার হয়ে গেল। আমাকে ছেড়ে আসতে হলো সেই চিরচেনা পরিবেশ। গাছগাছালির সান্নিধ্য থেকে আমার জায়গা হলো শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে। এরপরে আর যতই মামাবাড়ি যাই না কেন, আগের মতো সেই অনুভূতি আর আসে না।
সেই গাজর বাগানের ওখানে উঠেছে আরেকটি ঘর, বারান্দা ভেঙে গড়ে উঠেছে রান্নাঘর। বাড়ির খসে পড়া দেয়াল ঢেকে গেছে এখন কুৎসিত কমলা রঙের নিচে। কামরাঙাগাছটিও আর নেই। উঠানে আর আগের মতো কাঠবিড়ালি আসে না। পুকুরটি এখন পরিণত হয়েছে ডোবায়। এখন এই ব্যস্ততার যুগে ২-৩ বছরে একবার মামাবাড়ির দেখা পাই। বড্ড মনে পড়ে সেই সব মিষ্টি দিনগুলোর কথা।
এসএসসি পরীক্ষার্থী, মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, চাঁদপুর