একজন শহীদজায়া ও ৭১ স্মৃতিবিজড়িত ‘মুশতারী লজ’
হাসপাতালের বেডে শুয়ে ডায়েরির পাতায় জীবনের শেষ লেখাটি লিখে গেছেন, ‘এখন প্রতিবাদ চাই। প্রতিরোধ চাই। চাই রাজনৈতিক আদর্শিক সংগ্রাম। যারা ১৯৭১–এ নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েছে এবং নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সেই খুনিদের সাথে কোনো আপস হতে পারে না। এবার বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক। অতীতের সব ত্রুটিবিচ্যুতি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক।’
শহীদজায়া মুশতারী শফির শেষ লেখাটিতে ছিল একাত্তরের চেতনা এবং প্রতিবাদ।
চট্টগ্রাম বন্ধুসভায় কাজ করার সময় থেকে শহীদজায়া মুশতারী শফিকে চিনতাম। আমি আন্টি বলে সম্বোধন করতাম। ২০১৫ সালে দৈনিক আজাদীতে ‘খোলা হাওয়া’ বিভাগে শহীদ ছবুরকে নিয়ে লেখা ‘যুদ্ধ শেষে যে ছেলেটি বাড়ি ফিরেনি’। আমার লেখা ফিচারটি পড়ে শহীদ ছবুরের সহযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান আবেগাপ্লুত হয়ে ফোনে বলেছিলেন, ‘বাবা রশীদ এনাম, তুমি একটা বই করো।’
একদিন মুশতারী শফিকে মুঠোফোনে ‘একাত্তরের শহিদ ছবুর’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি দেখার কথা বললাম। তিনি আমাকে বাসায় ডাকলেন। অবশেষে এক পড়ন্ত বিকেলে ‘মুশতারী লজ’–এ গিয়ে হাজির । ‘একাত্তরের শহিদ ছবুর’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে মুশতারী শফি মুগ্ধ হলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে পরম যত্ন করে বইয়ের ভূমিকা লিখলেন। ২০১৬ সালে বইটি বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হলে ‘মুশতারী লজ’–এ গিয়ে বইটি মুশতারী শফির হাতে তুলে দিই। তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘রশীদ এনাম বাবা, দেখো! শহীদ ছবুরের মতো অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জীবন ধামাচাপা পড়ে আছে। তোমার মতো যদি অন্যরা এভাবে লিখত, আগামীর প্রজন্ম শহীদ ও একাত্তরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত।’
মাঝেমধ্যে মেহরাজ ভাই ও তারানা শফি আপুর কাছ থেকে ফোনে খোঁজখবর নিতাম। ২০১৮ সালে ডায়েরি, ক্যালেন্ডার নিয়ে মুশতারী লজে দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম। মুশতারী আন্টির সঙ্গে গল্প করতে করতে ধোঁয়া ওড়া ট্রে–ভর্তি চা–নাশতা এসে হাজির। একাত্তরের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছিলেন। এটাই ছিল মুশতারী আন্টির সঙ্গে শেষ দেখা।
২০১৯-২০২০ সালে করোনার কারণে মুশতারী লজে যাওয়া হয়নি।
‘একাত্তরের শহিদ ছবুর’ বইয়ে মুশতারী শফির লেখা ভূমিকার কিছু অংশ তুলে ধরলাম,
‘হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশটি আমরা নিজস্ব করে পেয়েছি। অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত, অনেক তিতিক্ষা এবং পরিশেষে তিরিশ লক্ষাধিক বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির এমন একটি জায়গা ছিল না, যেখানে শহিদের রক্ত ঝরেনি এবং তাঁদের অনেকের দেহাবশেষের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত নেই। কেউ ভেসে গেছে পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলী নদীর বুকে, কেউ ভেসে গেছে অথৈ সমুদ্রের মাঝে, কেউ কেউ পাহাড়ে জঙ্গলে শেয়াল–শকুনের আহার্য হয়েছে, আর কিছুসংখ্যক মানুষকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। তখন যেখানে সুযোগ হয়েছে সেখানে। পাশাপাশি অজস্র গণকবর আর বধ্যভূমিতে ভরেছিল এই দেশটি। এ রকম পরিস্থিতিতে গাজী আবদুস ছবুরও শাহাদতবরণ করেছেন।
‘আজ একাত্তরের প্রজন্ম লেখক রশীদ এনাম তুলে এনেছেন শহিদ আবদুস ছবুরকে। উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবদুস ছবুর স্মৃতি পাঠাগার ও শহিদ আবদুস ছবুর স্মৃতি ট্রাস্টের কথা এবং এই শেয়ানপাড়া গ্রামেই শহিদ ছবুরের নামে একটি ইশকুল বা কলেজ ও স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এভাবেই তাঁর স্মৃতি ও কর্মকাণ্ড প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকবে। তবে তাঁর কবর যেখানে আছে, তা আরও সুন্দর সুসংহত করে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই।’
(বেগম মুশতারী শফি)
২৫/১২/২০১৫
‘মুশতারী লজ’
ছোটবেলায় বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন উম্মে কুলসুম মুশতারী বেগম ওরফে ডলি। তিনি ১৯৩৮ সালে ১৫ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলায়। পিতা খন্দকার নজমুল হক আনসারী, মাতা আরেফা খাতুন। বাবা ছিলেন ডেপুটি পুলিশ সুপার। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় বসবাস করতেন। মাত্র তিন মাস বয়সে ছোট্ট ডলি মাকে হারান। বাবাও ১২ বছর বয়সে না–ফেরার দেশে চলে যান। শিশুকাল থেকে শুরু হয় মুশতারীর জীবনসংগ্রাম। কত চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল বিষাদ আর সংগ্রাম।
চট্টগ্রাম থেকে ‘বান্ধবী’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৯ সালে ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানাও চালু করেছিলেন।
১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন ‘বান্ধবী’ পত্রিকায় প্রচ্ছদ ছাপা হয় দেশের মানচিত্র, তার ওপর বেয়নেটের আঘাতের ছবি। এই ছবি দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করে বুঝিয়েছিলেন যে এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। দেশ রক্ষায় সবাইকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন ‘মেয়েদের প্রেস’।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে ‘মুশতারী লজ’ ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ স্থল। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গোলাবারুদ মুশতারী লজে লুকিয়ে রাখতেন। এটাই মুশতারী শফির পরিবারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে ৭ এপ্রিল মুশতারী পরিবারের জন্য ছিল ভয়াবহ দিন। সেদিন রাতে পাকিস্তানিরা ডাক্তার শফি ও মুশতারীর ছোট ভাই এহসানুল হক আনসারীকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মুশতারী শফি। তাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বামী, ভাইহারা শহীদজায়া মুশতারী শফি তাঁর ফুলের মতো ছোট মাসুম সাত সন্তানকে নিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা চলে যান।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সন্তানদেরকে কখনো পিতার অভাব বোধ করতে দেননি। শহীদজায়া মুশতারী শফি সন্তানদের কাছে ছিলেন কখনো বটবৃক্ষ, কখনো পিতা ও মাতা উভয়।
তিনি বুকে আগলে রেখেছেন একাত্তরের স্মৃতিকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও একুশের গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ ইত্যাদি গ্রন্থ। তাঁর প্রতিটি বই একাত্তরের একেকটা প্রামাণ্য দলিল।
২০১৬ সালে শহীদজায়া মুশতারী শফিকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশিপ দেওয়া হয় এবং ২০২০ সালে তাঁকে রোকেয়া পদক দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিনি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন।
২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সবাইকে কাঁদিয়ে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান একাত্তরের জননী শহীদজায়া মুশতারী শফি।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা