এক.
যুদ্ধের বছর খুব ছোট ছিলাম। এত ছোট যে তখনো দিন-তারিখ বুঝি না। বাড়ির পাশে নদী। এক সকালে গেলাম নদীর ঘাটে। ওপারে ঘর ভাঙা হচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ নৌকায় পিতলের কলসি, থালাবাসন, টিনের চাল, খাটপালঙ্কসহ বিভিন্ন জিনিস লুপ করে আনছে। ভীষণ শব্দ পাচ্ছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। একসময় বড় ভাইকে কাঁদতে দেখলাম। কান্না একটা ছোঁয়াচে রোগ। বড় ভাইকে কাঁদতে দেখে আমিও কাঁদছি। বিষয়টি মাকে জিজ্ঞেস করলাম। কিছুই বললেন না। পরে জেনেছি সেদিনের ঘটনা। নদীর ওপারে ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতি। কিছু মানুষ তাদের বাড়িঘর ভেঙে আনছে। এই হলো আমার একাত্তরের প্রথম স্মৃতি।
তারপর গ্রামের বড় ভাইয়েরা যুদ্ধে গেলেন। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে বাড়ি পেতাম না। রাজনীতি করতেন। কিছুদিন পর আসতেন। যুদ্ধের দিনগুলোতে আরও পেলাম না। অনেক ভাইবোন নিয়ে মা একা। সাধারণ এক মধ্যবিত্ত পরিবার। ঘরে খাবার নেই। চারদিকে হাহাকার। সে এক নিদারুণ সময়!
পাশের গ্রামে মামাদের বাড়ি। এক মামার বিমানে চাকরি হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই যোগদানের কথা। তিনি যুদ্ধে গেলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে মেরে ফেলে। সন্তানের দুঃখে আমার নানি পাগল হয়ে যান। এভাবে জীবনে প্রথম পাগল দেখা। নানির কয়েকজন সন্তান—সবাই যুদ্ধে গেছেন। পাকিস্তানি বাহিনী এ খবর জেনে যায়। তারা শুধু মামাকে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, একদিন নানাবাড়িতে এসে সব লুটপাট ও ভাঙচুর করল। নানাকে খুঁটির সঙ্গে বাঁধল। কেরোসিন ঢেলে তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেবে। তারপর জানি না কেমন করে সেদিন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
বানের পানিতে ভেসে গেছে চারদিক। বাবা যে নৌকা বাইতে পারেন, এটা জানা ছিল না। একদিন নৌকায় নানাবাড়ি যাচ্ছি। বাবা হলেন নৌকার মাঝি। নৌকা চলছে ধানখেত দিয়ে। হঠাৎ বাবা পাঞ্জাবি খুলে গামছার মতো করে মাথায় বাঁধলেন।
মা বললেন, এটা কেন?
ওই যে দূরে নৌকা যাচ্ছে। ওই নৌকায় পাকিস্তানি আর্মি আছে। দেখলে মেরে ফেলতে পারে। আরও খারাপ কিছু হতে পারে। তাই বাবা সেদিন মাঝির অভিনয় করলেন। যেন পাকিস্তানি আর্মি মনে করে বাবা লেখাপড়া জানা মানুষ না। সাধারণ একজন নৌকার মাঝি মাত্র।
আরেক দিন নদী তীরে এক হাটে গিয়েছি। হঠাৎ সবকিছু ফেলে মানুষ দৌড়াচ্ছে! কিছুই জানি না। সবার সঙ্গে দৌড়াচ্ছি। কেবল হাটের মানুষ না, গ্রামের মানুষও দৌড়াচ্ছে। শেষে জানলাম, স্পিডবোটে মিলিটারি আসবে। এলাকা জ্বালিয়ে দেবে। সেদিন আর তারা আসেনি।
ঘরের সঙ্গে একটা পুকুর ছিল। সেটা ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, পুকুরে বাঁধা বিশাল এক নৌকা। এমন নৌকা প্রথম দেখলাম। ভেতরে একদম সাজানো ঘরের মতো। এ নৌকায় শুয়ে থাকা যায়, খেলা যায়, গল্প করা যায়; যা ইচ্ছা তা-ই করা যায়। আমাদের সেকি আনন্দ! পরে জানলাম, একে পানসি নৌকা বলে। অনেক দিন পুকুরঘাটে বাঁধা ছিল। সারা দিন খেলতাম, লাফাতাম, দৌড়াতাম। এক রাতে ঘুম থেকে উঠে সেই নৌকা আর দেখিনি। আর কোনো দিন জানা হয়নি—কারা এনেছিল, কারা নিয়ে গেল।
বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন। ট্রেনিং শেষে নিয়ে আসতেন। একবার বাড়িতে খবর এল, বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। মাসহ সবার সেকি কান্না! তখন সময় এমন যে কান্নাও করা যায় না। শত্রুরা শুনে ফেললে বিপদ হতে পারে।
আরেকবার গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত ভাই দরজার কড়া নাড়ছেন। মা দরজা খুললেন।
—কাকি, অস্ত্রটা একটু লুকাতে হবে।…
দুই.
একদিন দেখি, বকর ভাইদের বাড়িতে সবাই কান্না করছে। সে এক নিদারুণ কান্না! যেন আকাশ–বাতাস, প্রকৃতি—সবাই কান্না করছে। এই প্রথম এভাবে কান্না করতে দেখা। ৯ মাস যুদ্ধ হলো। যুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে বকর ভাইয়েরা নিজেদের থানা কালিয়ায় যুদ্ধ করছিলেন। সেটা ছিল একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর। তুমুল যুদ্ধ। জয় নিশ্চিত। বকর ভাই বিজয়ের উত্তেজনায় সবাইকে ছেড়ে সামনে গেলেন। ঠিক তখনই একটা গুলি তাঁর শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। শতচেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচানো গেল না। বকর ভাইয়ের শেষ উচ্চারণ ছিল, তোরা দেশটাকে দেখে রাখিস।
বকর ভাইয়ের রক্তে সেদিন যে দূর্বাঘাসের মাটি ভেসে গিয়েছিল, সেখানে একটি কৃষ্ণচূড়া জন্মেছিল। বছরের একটা সময় গাছটি ফুলে ফুলে ভরে যায়। মনে হয় বকর ভাই কৃষ্ণচূড়া ফুল হয়ে বারবার ফিরে আসছেন এই বাংলায়।
বড় ভাইয়েরা বলতেন শহীদ বকর ভাই। মনে করতাম, ওনার নাম ‘শহীদ বকর ভাই’। পরে জানলাম, দেশের জন্য যাঁরা জীবন দেন, তাঁরাই শহীদ।
তারপর একটু একটু করে বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকে মনের মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগে—কেন মারা গেলেন মামা, কেন ভাই। আরও পরে জানা গেল, শুধু মামা আর ভাই নয়, লাখো শহীদের রক্তে ভিজেছে বাংলার মাটি। মনে হয় বাংলার মাঠঘাট, প্রান্তর—যেখানেই পা রাখি, সেখানেই আছে শহীদের রক্ত। বিমূর্ত এমন ভাবনার মধ্যেই শেষ হলো স্কুল ও কলেজজীবন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এসব বিষয়ে জানার চেষ্টা। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার যে সূর্য ডুবে গিয়েছিল পলাশীতে, সেই অস্তমিত সূর্যের উদয় হলো একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। এই দীর্ঘ সময় এ জনপদের মুক্তির জন্য ফরায়েজি, দুদু মিয়াদের আন্দোলন, তিতুমীর-সিপাহিদের বিদ্রোহ, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সুভাষচন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু, মাওলানা ভাসানীসহ কত দেশপ্রেমিকের সংগ্রাম। ঝুঁকি নিয়ে নিরন্তর লিখে গেছেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। জেল খেটেছেন। রবীন্দ্র-নজরুলসহ কবি–সাহিত্যিকদের সংগীত, লেখা, ভাবনায় এসেছে বাংলা–মুক্তির প্রেরণা। কিন্তু সত্যিকার কাজটি করেছেন এ দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। যাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাঁরা জানতেন না জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন কি না। এই লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।
লেখক, কবি, সংগঠক ও সাংবাদিক