আমরা সেই তরুণ প্রজন্ম, যারা একদিকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহচর্যে বড় হচ্ছি, অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধ, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির গভীরতা হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে চলছি দৃপ্ত গতিতে। আমাদের পথচলাটা হয়তো একটু ব্যতিক্রম, কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে ভরপুর সৃষ্টিশীলতা, কল্পনা ও সম্ভাবনার অশেষ রং।
আমরা যে সময়ে বড় হচ্ছি, সেখানে প্রযুক্তি, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটেছে। সবার হাতে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল মিডিয়া—এই উপকরণগুলো শুধুই বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং নিজেদের চিন্তা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। কেউ বানাচ্ছেন শর্ট ফিল্ম, কেউ ছবি আঁকছেন ট্যাবলেটে, কেউ আবার কবিতা পড়ছেন ক্যামেরার সামনে। আমরা আজ মুক্ত মনের সন্তান, যারা জানে ভাবনা ছড়িয়ে দিতে হলে কলম, কাগজ বা গানের গলা, সবকিছুই হতে পারে একেকটি শক্তিশালী মাধ্যম। যখন নিজেদের গড়ে তুলছি, তখন চারপাশের জগৎ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত শিখতে হচ্ছে, মানিয়ে নিতে হচ্ছে এবং নিজেদের ভেতরের শক্তিকে বিকশিত করতে হচ্ছে। আমি নিজে গণমাধ্যম নিয়ে পড়ছি। বুঝতে পারি একটি ক্যামেরা, একটি মাইক্রোফোন, একটি শব্দ কেবল যন্ত্র নয়, সত্য ও সৌন্দর্যের অন্যতম বাহক।
এই প্রজন্মের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো আত্মসচেতনতা। জানি আমরা কে, কী চাই এবং কোথায় এগিয়ে যেতে চাই। এই আত্মজ্ঞান আমাদের সাহস দেয় নতুন কিছু নিয়ে ভাবার, চেষ্টা করার, আবার ভুল থেকে শেখার। প্রতিটি ভুল একেকটি শিক্ষার দিক্চিহ্ন। শুধু পড়াশোনার গণ্ডিতে আটকে না থেকে নিজের আগ্রহ, প্যাশন ও প্রতিভার পেছনে দৌড়াই। কেউ বিজ্ঞান ভালোবাসে, কেউ শিল্প, কেউ সামাজিক কার্যকলাপে নিজেকে মেলে ধরে। কেউ উদ্যোক্তা হতে চায়, কেউ গল্প বলার মাধ্যমে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে বা করতে চায়।
নতুন প্রজন্ম মানেই কেবল নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, বরং মানবিকতা, সহানুভূতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাও। অনেকেই এখন পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছে, প্লাস্টিকদূষণ নিয়ে সচেতনতা ছড়াচ্ছে, কিংবা সমাজে জেন্ডার–সমতা নিয়ে ভাবছে। সমাজ কেবল নীতিকথা দিয়ে বদলায় না, বরং ছোট ছোট পদক্ষেপে, ভালোবাসা দিয়ে, সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
দার্জিলিংয়ের একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করেছি। ছোট বয়সে মা-বাবার থেকে দূরে থাকা সহজ ছিল না। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে দায়িত্বশীল, নিয়মানুবর্তী ও আত্মনির্ভর হতে শিখিয়েছে। শিক্ষকদের ভালোবাসা, শাসন ও উৎসাহ জীবনের পথ ঠিক করতে সাহায্য করেছে। আজ বুঝি, জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি পরিস্থিতি একেকটি শিক্ষার ক্ষেত্র। কান্না করেছি, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি—এই ওঠা-পড়াটাই আমাকে মানুষ করেছে। আমাদের প্রজন্ম মানে—রঙিন চিন্তা, বিশ্বময় দৃষ্টি এবং গভীর অনুভব। আমরা স্মার্টফোনে ছবি তুলি ঠিকই, কিন্তু সেই ছবির ভেতর দিয়ে গল্প বলি, ইতিহাস ধরে রাখি, মানবিক অনুভূতি প্রকাশ করি। আমরা গান গাই, কিন্তু সেই গানে শুধুই সুর থাকে না, থাকে সময়ের প্রতিবিম্ব, সমাজের কথা, ভালোবাসার স্পর্শ।
আজকের তরুণ প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করছে। বিশ্ব এখন একটাই গ্রাম। তারপরও আমরা শিকড় ভুলি না। বাঙালি সংস্কৃতি, গান, নৃত্য, নাটক ও সাহিত্যের মধ্যে বেড়ে উঠছি। শিল্পচর্চা মানেই আত্মার অন্বেষণ। আমরা কেবল ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক নই, বর্তমানের ভাবনার উৎসও। আমাদের মধ্যে রয়েছে প্রশ্ন করার সাহস, নতুন কিছু গড়ার আগ্রহ এবং সব সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা। আমরা জানি, একে অপরকে সম্মান করলে, সহযোগিতা করলে, পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
নতুন প্রজন্ম সম্ভাবনার এক অনন্য নাম। আমরা সুযোগকে কাজে লাগাতে জানি; সামর্থ্য দিয়ে, সাধনা দিয়ে, মনন দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যাচ্ছি আমরা পারি। আমরা শান্তির স্বপ্ন দেখি। কাজের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে, ভালোবাসার মাধ্যমে এক নতুন ভোরের আলো বয়ে আনতে চাই। আমরা সম্ভাবনার দীপ্ত প্রতিচ্ছবি।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ, সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগ, গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।