বৃহস্পতিবার। ১১ ডিসেম্বর।
সন্ধ্যা। লেখক-শিল্পীদের এক আনন্দময় কাফেলা নিয়ে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে বসলাম। মেঘনা নদীর বুক চিরে আমরা চললাম এক অপার সৌন্দর্যের রাজ্যে—ভোলা জেলার মনোমুগ্ধকর দ্বীপ উপজেলা, মনপুরায়।
যাত্রার শুরুতেই প্রকৃতি যেন তার আঁচল মেলে ধরে। জলভরা নদী। যত দূর চোখ যায়, জল আর জল। সে জলের ওপর চাঁদের আলো যেন মুক্তোর মতো ঝলমল করছিল।
যেতে যেতে দূর থেকে চোখে পড়ল ছোট ছোট চর, গাছগাছালিতে ভরা। ওরা যেন মেঘের রাজ্য হয়ে ভেসে আছে জলের ওপর।
আমাদের লঞ্চের ভেতর চলছে গান আর আবৃত্তির আসর—শিল্পের সেই সুর আর নদীর শান্ত জল একাকার হয়ে তৈরি করেছিল অসাধারণ এক মোহনীয়তা।
রাতের অন্ধকার ভেদ করে ভোরের আলো ফোটার সময় যখন মনপুরায় পৌঁছালাম, তখন বুঝলাম, এটা শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরের এক শান্ত পৃথিবী। ভোলা জেলার এই দ্বীপ উপজেলা, পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত, চারদিক ঘিরে আছে দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনা। এই মেঘনা নদীই দক্ষিণে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরের বিশালতায়। স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে যাকে বলে ‘সি বিচ’। নামটার মধ্যেই যেন কেমন এক মমতা লুকিয়ে আছে।
মনপুরার মানুষগুলো অবাক করার মতো সহজ–সরল আর অতিথিপরায়ণ। অধিকাংশই মৎস্যজীবী—নদী আর সাগরই যাঁদের জীবন। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া, তারপর সেই মাছ আড়তে বিক্রি করা, এই তাঁদের কাজ। দৈনন্দিন জীবনের গল্প। মৎস্যজীবীর বাইরে কিছু কৃষিজীবী আর হাতে গোনা কিছু মানুষ প্রবাসী। অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা খুব বিত্তবান নন, কিন্তু জীবনে একধরনের স্বস্তি আর তৃপ্তি আছে, যা শহরে খুব একটা দেখা যায় না।
মনপুরার প্রকৃতি নিজেই এক জীবন্ত কবিতা। বিশাল মেঘনা নদী—যেন কূল নাই, কিনার নাই। বেশি ভালো লাগল সি বিচের পাড়ে বসে থাকার মুহূর্তগুলো। নীরবতা, হালকা বাতাস, ঢেউয়ের মৃদু শব্দ—সব মিলিয়ে মনপাগল করা দৃশ্য। মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি নিজেই নিজের হাতে মনটা ধুয়ে দিচ্ছে। সেখানে বসে থাকা মানে নিজের ভেতরের শব্দগুলোকে পাখনা মেলে উড়তে দেওয়া।
পশুপাখির উপস্থিতি একে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। ঘুঘু, শালিক, বুলবুলি—এত কাছ থেকে দেখা, এত অবাধ স্বাধীনতায় ওদের ওড়াউড়ি দেখে মনটা ভরে গেল। মনে হলো, এই দ্বীপে প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে এক নিখাদ বন্ধন টিকে আছে।
ফেরার পথেও সেই একই নদী, একই গান; কিন্তু অনুভূতি ভিন্ন। মনপুরা শুধু একটি জায়গা নয়, যেন হৃদয়ের এক নীরব ঠিকানা। এমন এক জায়গা যেখানে গেলে মানুষ অন্য মানুষ হয়ে ফিরে আসে। মনপুরা শিখিয়েছে, সুন্দর হতে হলে খুব বেশি কিছু লাগে না। একটু নদী, একটু আকাশ, কিছু সহজ–সরল মানুষ আর প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালোবাসাই যথেষ্ট।
এ ভ্রমণ থেকে মনে গেঁথে গেল, শহুরে কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে হৃদয় ছোঁয়া এক শান্তিনিবাসের সন্ধান করলে মনপুরাই হতে পারে সুন্দর গন্তব্য। এটি কেবল একটি ভ্রমণস্থান নয়, এটি প্রকৃতির এক নিবিড় পাঠশালা। যেখানে মেঘনার বিশালতা মনে জন্ম দেয় নতুন সাহস। এখানকার মানুষের সরলতা শেখায় জীবনের আসল মানে। সি বিচের পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মনে হয়, পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর আর আবেগঘন দৃশ্য বুঝি আর নেই।
মনপুরা যেন হাতছানি দিয়ে বলে যায়, এসো আমার ঘরে। আমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মোহময় ডালি নিয়ে বসে আছি তোমাদের জন্য।