কালের সাক্ষী গান্ধী আশ্রম: ঐতিহ্যে বাঁধা এক ইতিহাস
গান্ধী আশ্রম, জামালপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত পল্লির বুক চিরে প্রবাহিত ঝিনাই নদের তীরে অবস্থিত। ১৯৩৪ সালে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের কাপাশহাটিয়া গ্রামে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তৎকালীন জামালপুর মহকুমার কংগ্রেসের সম্পাদক কৃষকনেতা নাসির উদ্দিন সরকার নামের এক ব্যক্তি।
শৈশব-কৈশোরে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক পদাঙ্ক অনুসরণ করেন নাসির উদ্দিন সরকার। যুক্ত হন ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের শৃঙ্খল ভাঙার সংগ্রাম এবং মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত অহিংস-সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। দেশপ্রেম, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে তিনি ১৯৩১ সালে জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সমাজ, রাষ্ট্রের মানবকল্যাণে ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গান্ধী আশ্রম। আশ্রম পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন নাসির সরকারের কন্যা রাজিয়া খাতুন ও মানবহিতৈষী নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন। ওই সময় তাঁদের সহযোগিতা করেন তৎকালীন জামালপুর মহকুমা কংগ্রেস সভাপতি ডা. রমনী মোহন দাস।
প্রতিষ্ঠাকালে আশ্রমের কার্যক্রম শুরু হয় খাদি কাপড় বুনন, শিক্ষাসেবা, পাঠাগার কার্যক্রম, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, সমাজ ও ব্যক্তি উন্নয়ন কার্যক্রম, হস্তশিল্পের প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। প্রতিষ্ঠালগ্নে আশ্রমটি এলাকার জনমানুষ এবং জ্ঞানী-গুণীদের ভরসার আড্ডাস্থল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আশ্রমটি গুঁড়িয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় আশ্রমের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আশ্রমের ঘরটি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাঙালির মুক্তির পথ অনুসন্ধানে প্রায় ৩০ বছরের ব্যবধানে এই আশ্রমে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক সভা হয়েছে। কালের তাগিদে তাতে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, বারীন দত্ত প্রমুখ।
২০০৭ সালের ২ অক্টোবর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে গান্ধী আশ্রমের কার্যক্রম আবার শুরু হয়। বর্তমানে এটি চলছে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে। নতুনভাবে আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর’ নামটি। সবুজ শ্যামলীমায় ভরা গ্রামটি এখন পাখপাখালির অভয়ারণ্য। সন্ধ্যা নামলেই পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়।
মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটি দোতলা। নিচের তলা সাজানো রয়েছে আলোকচিত্র দিয়ে, যেখানে চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠর তথ্যাদি ও ছবি। রয়েছে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল, তাঁদের নামসহ তথ্য সংবলিত প্রদর্শনী বোর্ড। জাদুঘরের সিঁড়ির কাছেই নামফলক খচিত খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। আছে মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের একটি মানচিত্রও। রয়েছে জামালপুর-টাঙ্গাইল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত নানা ইতিহাস।
আরও রয়েছে জামালপুর-শেরপুর অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থান গরজরিপার টিপু পাগলের দুর্গ থেকে উদ্ধারকৃত পাথর। এ পাথরের টুকরাগুলো মনে করিয়ে দেয় পাগলপন্থী বিদ্রোহের কথা। ইংরেজ শাসন ও জমিদার গোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ অঞ্চলে গারো বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ১৮০২ সালে। সে সময় গারো রাজ্য স্থাপনে গারো সর্দার ছপাতির প্রয়াস ব্যর্থ হলে টিপু পাগলের নেতৃত্বে গারো ও অন্যান্য প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ‘সকল মানুষই ঈশ্বরসৃষ্ট, কেহ উচ্চ, কেহ নীচ এই রূপ প্রভেদ করা সঙ্গত নহে’—এই পাগলপন্থী ধর্মমতে গারোদের দীক্ষিত ও সংগঠিত করেন টিপু পাগল।
এখানে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা তথ্য, বাংলার নবাব মীর কাশিম, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস রয়েছে। মুক্তিসংগ্রামের নানা স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমির মাটিসহ সংরক্ষণ করা হয়েছে স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে গান্ধী আশ্রমের ব্যবহৃত চরকা, পুরোনো সিন্দুক, চেয়ার-টেবিল, নানা ধরনের সূচিকর্ম। তৎকালীন নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, কিষান-কিষানিদের ব্যবহার্য সামগ্রী। প্রতিষ্ঠাতা নাসির সরকারের স্মৃতি ধরে রাখতে আশ্রমে নাসির সরকার স্মৃতি পাঠাগারের দুর্লভ সংরক্ষণ কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দৃশ্যমান।
বাইরের খোলামেলা পরিবেশেসহ প্রায় ১ একর জায়গাজুড়েই নানা ফুলের বাগানে সজ্জিত এই আশ্রমটি নেহাতই একটি স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘরই নয়, বরং এটি কালের সাক্ষী হয়ে দণ্ডায়মান এক অমলিন ইতিহাস।
সাধারণ সম্পাদক, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা