আমার আব্বাটা বদলে গেল
আমার একটা সহজ জীবন ছিল। যে জীবনে একটা কলম চাইলে আব্বা এক ডজন এনে দিতেন, এক দিস্তা কাগজ চাইলে এক রিম কাগজ এনে দিতেন। ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য মাছ খেতাম না বলে আমার জন্য বাজার ঘুরে নিয়ে আসতেন ইলিশ মাছ। এখন যখন হরেক জাতের মাছ খাই, আব্বা শোনেন, হাসেন, আর বলেন, ‘আগে তো ইলিশ মাছ না হলে মাছই খেতে না!’
পৃথিবীতে জীবনকে সহজ করার জন্য, আমার মতো করার জন্য আব্বার মতো করে আর কেউ ভাবতে পারে না।
যখন বেশ ছোট ছিলাম, সাত-আট বছর বয়স। বৃষ্টির দিনগুলোতে আব্বা ২০ টাকার বাদাম আনতেন। সেই সময় ২০ টাকার বাদামের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। আব্বা বাদাম ছিলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতে দিতেন আমাদেরকে। বৃষ্টির দিনে মফস্সলে আমাদের একতলা বাসার ধূসর মেঝেতে আমরা লুডুর বোর্ড ছড়িয়ে বসে যেতাম, দল বেঁধে লুডু খেলতাম, হইহুল্লোড় হতো বেশ! শৈশবে পারিবারিক মধুর সময় মনে করতে বললে এই দৃশ্যই চোখে ভাসে!
২০০৪ সালের বন্যার সময়ের কথা, আমরা তখন একতলা থেকে দোতলায় স্থানান্তরিত হয়েছি। আমাদের দোতালা বাসার নিচতলা পানিতে থই থই।
আব্বা এক হাতে সবুজ গুটি চেপে ধরে ‘ছক্কা ছক্কা’ করে দান মারতেন। রোলিং ডাইসে ছক্কা পড়লে আব্বা উল্লাস করে হেসে উঠতেন। সেই উল্লাস, সেই হাসির শব্দ এখনো কান পাতলেই শুনতে পাই।
আব্বা যখন হাসতেন, পাশে এসে বসতেন, মনে হতো গোটা পৃথিবীটা আমার! আব্বা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার রেজাল্ট কার্ডের পাশে যখন সিগনেচার করতেন, গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠত। আমি পড়তাম, আব্বা বাড়িতে ফেরার সময় হলে গলার আওয়াজ আরেকটু বাড়িয়ে দিতাম।
আব্বা ব্যবসা করতেন। অন্য জেলায় কাজের জন্য গেলে ফিরতে গভীর রাত হতো। রাত একটা কিংবা দুইটায়ও ফিরতেন কখনো কখনো। ঘরে সবাই তখন ঘুমে, শুধু আমি ডাইনিং টেবিলে বই জড়ো করে বসে বসে পড়তাম, পড়তেই থাকতাম, আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম, আব্বা আসতে আর কত দেরি! আমি পড়ছি, রাত জেগে পড়ছি, পড়তে আমার ভালো লাগত। আর ভালো লাগত আব্বার প্রশংসা পেতে, আব্বার খুশি হওয়া দেখে। আব্বা খুশি হতেন, আমার ছোট ছোট অর্জনেও তিনি আনন্দিত হতেন, গর্ব করতেন।
২০০৪ সালের বন্যার সময়ের কথা, আমরা তখন একতলা থেকে দোতলায় স্থানান্তরিত হয়েছি। আমাদের দোতালা বাসার নিচতলা পানিতে থই থই। কৈশরের শুরুর সময়টা তখন। কেবল প্রাইমারির গণ্ডি পার করেছি। চট করে চাইলেও আব্বার গা ঘেঁষে বসতে পারতাম না, গল্প শুরু করতে পারতাম না, এমন একটা বয়স।
সেই বন্যায় কোনো একটা দরকারে আমাদের একটু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল। নৌকা পর্যন্ত যেতেও পানিতে আমাদের গা ভিজে যাবে, এমন অবস্থা। আব্বা আমাকে কোলে তুলে নিলেন।
আমি দুই হাতে আব্বার গলা শক্ত করে ধরে রাখলাম, আব্বা পানির স্রোত ঠেলে ঠেলে আমাকে নিয়ে নৌকার দিকে যাচ্ছেন। কোলে ওঠার বয়স পেরিয়ে এসেছিলাম সেই কবে, কিন্তু বন্যার পানি পার করিয়ে দেওয়ার সুবাদে আমি আবার আব্বার কোলে চড়লাম। আমি যে কী ভীষণ নিরাপদ আর গর্ব অনুভব করেছিলাম, সে আমার কিশোরীবেলা জানে!
বন্যায় লোকে কত কিছু হারায়—ঘরবাড়ি, মানুষ, মূল্যবান সম্পদ, কত কিছু! সদ্য শৈশব কাটিয়ে ফেলা এক কিশোরী সেই বন্যায় পেয়েছিল একটুকরো মূল্যবান স্মৃতি! শেষবার পিতার কোলে চড়ার স্মৃতি। এখনো তাজা! এখনো গৌরবের!
সময় গড়াল কত! আমার আব্বাটা বদলে গেল। আমার সুপারম্যান, আলাদিনের জাদুর জিন জীবনের ঘাত–প্রতিঘাত পেরিয়ে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আব্বা এখন আর উল্লাস করে হাসেন না, লুডু বোর্ডে আমাদের খেলা আর জমে না। আমাদের মফস্সলের সেই বাসাটার তিনতলায় আমার আব্বা বসে থাকেন, দিন গোনেন, আর ছেলেমেয়ের হইচই শোনার জন্য কান পেতে থাকেন।
গোসল শেষে আব্বা নিজ হাতে লুঙ্গি কাচেন, গামছাটা খাটের স্ট্যান্ডে মেলে দেন টান টান করে। এই দৃশ্যে কিছু নেই, তবু আমারে কেন জানি টানে। আব্বার গায়ে ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবি, গায়ে আতরের সুগন্ধে মাখামাখি। বাইরে যাওয়ার জন্য যখন হাতের লাঠিটা খোঁজেন, আমি বুঝতে পারি, আব্বা এখন নিজের শক্তিতে হাঁটতেও কষ্ট পান! কিন্তু মানতে পারি না। কীভাবে মানি! আব্বা যে এখনো আমার কাছে সুপারম্যান, আমার আলাদিনের জাদুর জিন। আব্বা হাসলে আমার জীবন এখনো সহজ, আব্বা ভেঙে পড়লে আমিও নিজের মধ্যে ভাঙনের শব্দ পাই।
তবু উঠে দাঁড়াই, জীবন চালাই, আব্বা শিখিয়েছেন, কঠিনকে সহজ করার রাস্তা দেখিয়েছেন। আমি সেই পথ ধরে হাঁটি রোজ আর বলি, আব্বা আপনাকে ভালোবাসি, এক পৃথিবী সমান ভালোবাসি।