খোলা জানালার পাশে

চারপাশে সবুজ ঘাসের মাঝখানে রেললাইন, তার ওপর আমাদের ট্রেন চলছেছবি: আনাস খান

‘ঝক ঝকাঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে ঐ
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?’

কবি শামসুর রাহমানের ‘ট্রেন’ কবিতাটি শৈশবের ভালো লাগার একটা অংশজুড়ে রয়েছে। যতবার ট্রেনে উঠি, কবিতাটি মনে পড়ে। এবারের ট্রেন ভ্রমণটি ছিল অন্য রকম এক আবহে। সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে চলে এলাম রেলস্টেশন; সঙ্গে প্রিয়াংকা, আনাস ও নাফিস। গন্তব্য ঢাকার তেজগাঁও রেলস্টেশন। অনেক দিন ভোর দেখা হয় না। এই সকালে সবাই কত ব্যস্ত; কেউ শরীরচর্চা করছে, কেউবা জিনিস ফেরি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রেস্তোরাঁগুলো যেন আড়মোড়া ভেঙে চা ও নাশতা বানাতে ব্যস্ত। রিকশায় করে খোলা আকাশের নিচে মেঘে ভেজা সকাল মন ভালো করে দিল। নরসিংদী কমিউটারের একেবারে শেষের বগিতে জায়গা করল আনাস। ‘নাহিদ ভাই টিকিট লাগবে না, চলে আসো’, আনাস তাড়া দেয়।

তবু সচেতন নাগরিকের মতো ট্রেনে ওঠার আগে চারটি টিকিট কাটি। ভৈরব রেলস্টেশন এলেই ভেতরে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করে। দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে এই স্টেশন থেকেই নানা গন্তব্যে যাতায়াত করি। এখানকার প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন, তাদের গল্প ভিন্ন। একটা জায়গায় সবার বেশ মিল, তা হলো অপেক্ষা। সবাই অপেক্ষায় থাকে; কেউ বাড়ি ফেরার, কেউবা প্রিয়জনের। আমরা অপেক্ষা করছি ট্রেন ছাড়ার জন্য।

কয়েক মিনিট পর হঠাৎ উল্টো দিকে ট্রেন চলা শুরু করল। বুঝতে পারলাম, লাইন পরিবর্তন করার জন্য। পেছনের দরজা খুলতেই যেন নতুন এক দৃশ্যপট। চারপাশে সবুজ ঘাসের মাঝখানে রেললাইন, তার ওপর আমাদের ট্রেন চলছে উল্টো পথে। ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের মতো ট্রেনকে বলতে ইচ্ছা করল, ‘ট্রেন, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

ট্রেনের সিটে আমাদের আড্ডা জমে ওঠে
ছবি: আনাস খান

মেঘের দেশ থেকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের আলো, সঙ্গে ভোরের ঠান্ডা বাতাস, এ যেন অপার্থিব আনন্দ। গতি বাড়ার পর সিটে এসে আমাদের আড্ডা জমে ওঠে। ট্রেন একেকটা স্টেশন বিরতি দিচ্ছে আর নাফিস সেই স্টেশন সম্পর্কে বলছে। প্রিয়াংকা তার ট্রেন ভ্রমণের মজার কিছু স্মৃতিচারণা করল। এ দুজনের কথা খুব ভালো লাগে, দুজনই বেশ সাংগঠনিক। ভৈরব বন্ধুসভার অন্যতম বন্ধু।

ট্রেনে ভিড় নেই, হকারের আনাগোনা নেই, কারও অযাচিত উৎপাত নেই, এমনকি গার্ড বা টিটিও নেই। জানালায় প্রকৃতি দেখে মন ভরছিল না। আবার চলে গেলাম শেষ দরজার কাছে। প্রিয়াংকাকেও ডেকে নিলাম। আনাস ছবি তুলে দিল। প্রিয়াংকা বলছে, ‘ভালোবাসায় মোড়ানো সূর্যোদয়, এ যেন স্বপ্নের ভ্রমণ।’ কত সুন্দর শব্দচয়ন তার। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি, উড়ন্ত চুল ও মিষ্টি হাসিমাখা চোখে আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছে।

ঘোড়াশাল পার হওয়ার পর ট্রেন বিরতি নেয়, ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশনে। তখন নাফিস বলে, ‘খেয়াল করবেন, এখানে দুটি স্টেশন একই নামে, পার্থক্য শুধু ফ্ল্যাগ। এটা স্থাপন করা হয় একজন জমিদারের জন্য। তাঁর জন্য রেলগাড়িতে বিশেষ একটি কামরা থাকত।’

স্টেশনের আশপাশের নান্দনিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করল। আবারও ট্রেন চলছে হেলেদুলে, স্পিড মিটারে চেক করছিলাম গতি কেমন, কখনো ৫৬, কখনো ৬০ কিমি/ঘণ্টা। চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নতুন কিছু তথ্য জেনে নিলাম।

অবশেষে পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্য তেজগাঁও রেলস্টেশন। ট্রেন থেকে নামার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, এত দ্রুত কেন শেষ হয়ে গেল ভ্রমণ! খোলা জানালার পাশে আমাদের এই ট্রেন ভ্রমণ স্মৃতির পাতায় থাকবে।