এই ছেলেরাও জানত যুদ্ধে গেলে আর ফিরে না-ও আসতে পারে

দিনাজপুরে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধারাছবি: অমিয় তরফদার

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন–দানে।।
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো—

ওরা ছিল মাত্র ১৪ বছরের কয়েকজন কিশোর। একজন সেক্টর কমান্ডার ও সর্বাধিনায়ককে তীব্রভাবে প্রশ্ন করে, ‘দেশটা কি আপনার একার? দেশটা আমাদেরও। আপনার দলে না হোক, অন্য কোথাও গিয়ে অবশ্যই যুদ্ধ করবই করব। আমাদের আপনি বেঁধে রাখতে পারেন না।’

যদি মেজর কামরুল ইসলামের ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’ বইটি না পড়তাম, তাহলে কখনোই কিশোরদের এই সাহসী উচ্চারণের কথা জানতাম না।

ভোররাতে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত স্ত্রী জানতেন না শরিফ চলে যাবেন। তাঁর জন্য একটি ডিম ভাজতে দিয়েছিলেন কড়াইতে। কিন্তু তিনি সেই ডিম না খেয়েই চলে যান। এই শরিফ আর কোনো দিন যুদ্ধ থেকে ঘরে ফেরেননি।

একাত্তর সাল। চারদিকে যুদ্ধ। কামানের শব্দ। বারুদের গন্ধ। হাজার হাজার মানুষের লাশ। এখানে-সেখানে আর্তচিৎকার। কাছে-দূরে বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ঘুরছে। যুদ্ধের জন্য আর কী লাগে। এ সময় খালেদ মোশাররফ ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও কে ফোর্সের সর্বাধিনায়ক। কয়েকজন কিশোর তাঁর অফিসারদের বলল, ‘যুদ্ধ করতে চাই। আপনাদের দলে আমাদের নিতে হবে।’ খালেদ মোশাররফ খবর পেয়ে তাদের না দেখেই বেঁধে রাখতে বলেন। পরে ছাড়া পেয়ে কিশোরগুলো খালেদ মোশাররফের সামনে গিয়ে ওই সাহসী উচ্চারণ করেছিল।

এটা শুধু উচ্চারণ ছিল না। এটা ছিল তাদের জীবন উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্প। পরে এই কিশোরেরা যুদ্ধ করার অনুমতি পেয়েছিল। তারা হানাদার বাহিনীর বিশাল ট্যাংক ধ্বংস করেছিল। যে মানুষ যুদ্ধে যায়, সে জানে যে আর কোনো দিন ফিরে না–ও আসতে পারে। এই ছেলেরাও জানত যুদ্ধে গেলে তারা আর কোনো দিন ফিরে না–ও আসতে পারে। তবু দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তাদের কী দুর্নিবার স্বপ্ন!

যুদ্ধের বছর ‘প্রিন্সা’, এক অতি দরিদ্র রাখাইন মেয়ে ছিল। সে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে সম্ভ্রম হারায়। পরে প্রতিশোধ নিতে ১৪ জন পাকিস্তানি আর্মিকে বিষ খাইয়ে মেরেছিল।

শরিফ নামে ছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। বিয়ের পরই যুদ্ধে চলে যান। যুদ্ধের মধ্যে এক গভীর রাতে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সে রাতে কয়েক ঘণ্টা মাত্র তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন। ভোররাতে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত স্ত্রী জানতেন না শরিফ চলে যাবেন। তাঁর জন্য একটি ডিম ভাজতে দিয়েছিলেন কড়াইতে। কিন্তু তিনি সেই ডিম না খেয়েই চলে যান। এই শরিফ আর কোনো দিন যুদ্ধ থেকে ঘরে ফেরেননি। পরে এই নারীর একটি সন্তান হয়। এই সন্তান ও তিনি যত দিন পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন, কোনো দিন তাঁরা ডিম খাননি।

প্রতিমুহূর্তে শত্রু ও হানাদারদের ভয়। কখন কোন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। কখনো পাখির মতো মানুষ মারে। এমনি ভয়ংকর অনিশ্চয়তার এক দিনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিরুপায় হয়ে হঠাৎ একটি ঘরে আশ্রয় নেন। বাড়িতে কেউ নেই। কেবল একজন সদ্য বিবাহিত কম বয়সী নারী আছেন। তিনি খুব পর্দা করেন। কিন্তু ওই দিন এতজন মুক্তিযোদ্ধা তাঁর ঘরে প্রবেশ করার পরও তিনি ভয় পাননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই বাড়িতে রাজাকার আর পাকিস্তানি আর্মি আসে। সঙ্গে সঙ্গে বধূটি ঘোমটা দিয়ে বারান্দায় কোরআন শরিফ পড়া শুরু করলেন। এটা দেখে শত্রুরা চলে যায়। এর অল্পক্ষণ পরই মুক্তিযোদ্ধারাও ওই বাড়ি থেকে চলে যান। কিন্তু নিয়তি নববধূটিকে বাঁচতে দেয়নি। পাকিস্তানি সেনারা কীভাবে যেন ওই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে থাকার কথা জেনে যায়। তারা আবার ফিরে এসে বধূটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মানুষের বাড়িতে চুক্তিতে কাজ করতেন গণি। যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনিও।
দাদির ভিক্ষার অন্নে বড় হয়েছিলেন বাচ্চু। তিনি রাজাকারদের অস্ত্র চুরি করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন।
৭২ বছরের অহেদ কেরানি ছয়জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছিলেন।

এসব জেনেছি মেজর কামরুল ইসলামের ‘জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা’ উপন্যাস থেকে। প্রতীকী হিসেবে এই বইয়ের কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো।

এ ছাড়া শাহরিয়ার কবিরের ‘একাত্তরের যিশু’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’,  আনিসুল হকের ‘মা’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘অনিল বাগচির একদিন’, ‘শ্যামল ছায়া’সহ মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক বই পড়া হয়েছে। এসব বইয়ে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক বীরত্ব, রক্তক্ষরণ এবং নির্মমতার কথা উল্লেখ আছে।

মুক্তিযুদ্ধের বই পড়লে সত্যিকারভাবে বোঝা যায় কত মূল্য দিয়ে কেনা এই দেশ। আমরা যে শিশিরস্নাত ঘাস, ইট-পাথর, কাদা-পানিতে পা রাখি, এর প্রতিটি জায়গায় হয়তো শহীদের রক্তের দাগ আছে। বই না পড়লে সত্যিকার অর্থে কোনো জানাই সেভাবে জানা হয় না।

মুক্তিযুদ্ধের বই পড়লে প্রিয় বাংলাদেশের প্রতি অন্তর্জগতে এক অন্য রকম স্বপ্ন ও ভালোবাসা তৈরি হয়। সত্যিকার ভালো মানুষ হতে হলে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের বই পড়তে হবে। এসব বই পড়ার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ সত্যিকার দেশপ্রেমিক, আলোকিত, সমৃদ্ধ মানুষ হয়।

লেখক, কবি, সংগঠক ও সাংবাদিক