রক্তদান ও রক্ত জোগাড় করাতেই যত আনন্দ
সাবিনা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান প্রসব হবে। ডাক্তার ডেলিভারি করার জন্য সম্ভাব্য তারিখ দিয়েছেন ৯ ডিসেম্বর। জাহাঙ্গীর ভাই হতভম্ব হয়ে বলছিলেন, ‘ভাইয়া, রক্ত কই পাইবাম! আপনার ভাবির তো আরেকটা বাবু হইব। খুব টেনশনে আছি ভাই। ডাক্তার কইছে ১৫ দিন সময় বাকি। আর আপনের ভাবির শরীরে রক্ত নাকি কম আছে। অন্তত তিন-চাইর ব্যাগ তো লাগবই। আমি পড়ছি মহা পেরেশানিতে ভাই, সকাল থাইক্কা কম কইরা হইলেও ১০ জনরে কইছি। আপনের ভাবির রক্তের গ্রুপ বি নেগেটিভ।’
আমি বললাম, ‘ভাই, আল্লাহ ভরসা। ম্যানেজ হয়ে যাবে। চিন্তা কইরেন না, ১৫ দিন সময় তো? বিষয়টা আমি দেখতেছি। তা ছাড়া ডেলিভারিতে এত রক্ত লাগবে না। দেখছি কী করা যায়।’
এর ১১ দিন পর ৫ ডিসেম্বর একটা নম্বর থেকে কল আসে। কিন্তু আমি প্রথম আলো বন্ধুসভার সুধী সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কল রিসিভ করতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর আবার ফোনে রিং বাজল, অপরিচিত নম্বর। সালাম দিতেই, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের হাউমাউ! ‘নাজমুল ভাই, রক্ত লাগব, ডাক্তার কইছে আইসকাই সিজার করুন লাগব।’
আমি এক ব্যাগ আগেই জোগাড় করে রেখেছিলাম। বললাম, সমস্যা নেই, আমি দেখছি। এবার ডোনারকে কল দিলাম। ডোনার মিজান ভাই আর ফোন ধরছেন না। এবার চিন্তায় পড়ে গেলাম। চার-পাঁচটা ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করি ব্লাড লাগবে। ঠিক দুই ঘণ্টা পর মিজান ভাই কল রিসিভ করে বললেন, ‘ভাইয়া, আমি তো মাওয়া এসেছি।’ ওনাকে অনুরোধ করায়, তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে চলে এলেন। গাজীপুরের একটা ক্লিনিকে ভর্তি অবস্থায় ডোনার নিয়ে যাই। এক ব্যাগের বেশি রক্ত লাগেনি। জাহাঙ্গীর ভাই ও সাবিনা বেগম দম্পতির মেয়ে হয়।
রক্ত জোগাড় করে দেওয়ার পর জাহাঙ্গীর ভাই কৃতজ্ঞতায় আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘আপনি আমার ভাই। আজ আল্লাহ আপনের অসিলায় আমাদের বাঁচাইল।’
বাচ্চা প্রসব হওয়া অবধি আমি আর মিজান ভাই অপেক্ষা করছিলাম। কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের একজন নার্স বললেন, ‘মেয়ে বাবু হইছে! মা ও বাবু দুইজনই ভালো আছে।’
এই খবর শুনে জাহাঙ্গীর ভাই আবারও আলহামদুলিল্লাহ বলে আমাকে আর মিজান ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। এক অন্য রকম ভালো লাগার অনুভূতি।
প্রায় দিনই এমন সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হই। গত ১১ বছরে এই যুদ্ধে নিজে ২৮তম বার রক্তদানের পাশাপাশি এখন অবধি ৪৮৩ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে অর্ধহাজার পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছি। কারও কাছে ভাই, তো কারও কাছে সন্তান হয়েছি; ৪৮৩ ব্যাগ মানে ৪৮৩টা গল্প ও ভালো লাগা।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় ঠাকুরগাঁও সদরে গুলিতে আহত রোগী ও একজন সিজারের রোগীর জন্য দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে শুনে তখনকার আমার মেসের মোত্তাসিম ভাই আমাকে এসে বললেন, ‘ছোট্ট, দেখিয়ো তো একজন বি পজিটিভ ডোনার পাওয়া যায় কি না।’
আমি তখন মেসের সবার ছোট। খুব উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘ভাইয়া আমি দিতে চাই।’ যদিও তখন আমার রক্ত ডোনেট করার মতো বয়স হয়নি। তবু খুবই রিকোয়েস্ট করে মোত্তাসিম ভাই ও আইয়ুব ভাইকে রাজি করিয়ে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে সিজারের নারীকে এক ব্যাগ বি পজিটিভ রক্তদান করলাম। দারুণ এক অভিজ্ঞতা। মনে হয়েছিল, দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো কাজটি করেছি।
কয়েক দিন পর এসএসসি পরীক্ষা শেষ ও রেজাল্ট প্রকাশ হয়ে গেল। দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তির সুযোগ পাই। যাহোক, ক্লাস শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক পরে সব বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হলো। আমি ছিলাম ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল ও মিশুক। সবাই আমার কথায় গুরুত্বও দিত। একদিন সিয়ামকে বললাম, ‘বন্ধু চল, আমরা নতুন কিছু করি, চল একটা রক্তদানের গ্রুপ খুলি।’
যেই কথা সেই কাজ। সিয়াম, মশিউর, মোবারক আর সাজ্জাদ রাজি হলো। শাহনেওয়াজ স্যারের ম্যাথ ক্লাস শেষ হতেই আমি আর মোবারক ক্লাসের সবার উদ্দেশে বললাম, ‘একটা সংগঠন করতে চাই। যেটায় রক্ত ডোনেশনসহ নানা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ চলবে।’
সেদিন রাতে রুমে এসে ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলে ফেললাম। সঙ্গে একটি লোগোর ডিজাইন করে পরদিন ক্লাসের সবাইকে মাঠে ডেকে মিটিং করলাম। আমাদের কাজের উদ্দেশ্য ও কী কী করতে চাই, সব তুলে ধরি। সংগঠনের নাম দিলাম ‘পরিবর্তন’। সবাই সেদিন দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠে অঙ্গীকার করি, ‘আমরা মানুষকে রক্ত খুঁজে দেব আর দেশটাকে পরিষ্কার রাখব।’
সবাই তখন দারুণ উদ্যমী। কারও রক্ত লাগবে কল পেলে কেউ না করত না। পরে পলিটেকনিক জীবন শেষ হয়ে গেলেও আমরা ব্যক্তিগতভাবে কেউ এই মানবিক কাজ থামিয়ে দিইনি। সেই সময় থেকে সারা দেশের সব জেলার রক্তদাতা গ্রুপগুলোর ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলায় রক্ত খুঁজে দিয়েছি। আমার জন্য কাজটা সহজ হয়ে গেল বন্ধুসভা, স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, কমেডি ক্লাব, থিয়েটার আর টিআইবির সঙ্গে যুক্ত থাকায়। সংগঠন করার সুবাদে সারা দেশে আমার একটি নেটওয়ার্ক হয়ে গেল।
২০১২ সাল থেকে বন্ধুসভার সদস্য হই, আর টুকটাক যাতায়াত করতাম। ২০১৪ সাল থেকে পুরোদমে বন্ধুসভায় যুক্ত হওয়া। সেই যে শুরু করেছি, আর কখনো থামিনি। আর থামতেও চাই না। অল্প বয়সে স্থানীয় বন্ধুসভায় দুইবার সভাপতি ও তিনবার সাধারণ সম্পাদক হয়েছি। দিনাজপুর বন্ধুসভায় যুক্ত থাকাকালীন আমরা সবাইকে রক্তদানে উৎসাহ দিতাম। আরিফ ভাই আর মোহাম্মদ আলী ভাই সব সময় আমাকে এসব মানবিক কাজে আগ্রহী আর অনুপ্রেরণা দিত। বন্ধুসভার প্রত্যেক বন্ধুকে রক্ত দান করতে উৎসাহ দিতাম। মেয়ে বন্ধুরাও উৎসাহ নিয়ে রক্ত দিত।
২০১৬ সালে রওশন ভাই আমাকে মুঠোফোনে কল দিয়ে বলল, ‘তোমার রক্তদানের বিষয়টি নিয়ে লেখো। কয়েক লাইন লিখে আমাকে মেইল করে দাও।’
আমার রক্তদানের বিষয়টি বন্ধুসভার পাতায় ছাপানোর পর এমন কাজে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। যখন বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম, তখন সারা দেশের বন্ধুসভার বন্ধুদের নম্বর ও ফেসবুক আইডি জোগাড়ের চেষ্টা করতাম। কখন কোন জেলায় রক্তের প্রয়োজন পড়ে। অনেক জেলার বন্ধুদের রক্তের জন্য কল দিয়েছি। বন্ধুদের রাত ৩টায়ও কল দিয়ে রক্ত চেয়েছি। কাউকে বিরক্ত হতে দেখিনি।
সাংগঠনিক কাজের জন্য আমার সারা দেশের সঙ্গে কমিউনিকেশন স্কিলে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। একবার রাত দুইটায় বগুড়া বন্ধুসভার সুফিয়ান ভাইকে কল দিয়ে রক্ত চাওয়ামাত্র তিনি জোগাড় করে দেন। শুধু কি সুফিয়ান ভাই? রংপুরের অপূর্ব দাদা, রাজশাহীর বেলাল ভাই ও ভূমিকা, সিলেটের শাকিল ভাই, চট্রগ্রামের খলিল ভাই, কক্সবাজের সাইফুল, নাটোরের হাসান-হুসেইন, রোকন ভাই ও হেলাল ভাই, নওগাঁর তাসলিমা আন্টি ও তাসরিফ, ঠাকুরগাঁওয়ের বক্কর ভাই, পঞ্চগড়ের ওয়াকী ভাই, সৈয়দপুরের আসাদ ভাই, নীলফামারীর আরিফ, ময়মনসিংহের জুয়েল ভাই কিংবা দ্বীপজেলা ভোলার বন্ধু আশরাফুল ভাই আর চৈতিসহ সব জেলার কোনো না কোনো বন্ধুকে কল দিয়েছি। এখনো রাত ৩টা বাজেও রওশন ভাইকে রক্ত চেয়ে কল দিই।
একবার নাটোরের এক বোনের রক্তের প্রয়োজনে মিরাক্কেল-৬ চ্যাম্পিয়ন আবু হেনা রনি ভাইকে রাত ১২টায় কল দিই। তিনি বলে, ‘নাসিম চিন্তা করিয়ো না, দেখছি।’ ১৫ মিনিটের মধ্যে তিন ব্যাগ রক্তের জোগাড় করে দিলেন ভাই।
ভালো লাগার বিষয় হলো, রক্তের ব্যাপারে সবাই দারুণভাবে সহায়তা করেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে গাজীপুরে আসি। কিন্তু আমার কাজগুলো থেমে যায়নি। ব্যক্তিগত জীবনে থিয়েটার, অভিনয়, স্টেজ শো, মূকাভিনয়, মিমিক্রি সব ছাড়তে পারলেও রক্তদান আর বন্ধুসভা ছাড়তে পারিনি। রক্তদান আমার নেশা, আর বন্ধুসভা আমার প্রথম প্রেম।
মানবিক মানুষ মোশাররফ ভাই আর রেজা ভাই আমাকে গাজীপুর বন্ধুসভার বিভিন্ন কাজে ডাকতেন। এরপর আরও দারুণ দারুণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। নাঈমা, বাবুল ভাই, আরিফ, নাসির ভাই, সজীব ভাই, সুমন ভাইসহ অনেকের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
বন্ধুসভার সুবাদে গাজীপুরের বেশ কয়েকটি রক্তদানের গ্রুপে যুক্ত হয়ে যাই।
গাজীপুর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক আরিফ আমাকে ‘ব্লাড ডোনারস অ্যাসোসিয়েশন’–এর একজন সদস্য বানিয়ে দিল। নাসির ভাই আর আরিফ কী দারুণ কাজ করে। প্রতি মাসে অন্তত ৪০–৫০ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দেয় তারা।
গাজীপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা আমাকে এতটাই আপন করে যে বুঝতেই পারিনি আমি দিনাজপুরের বাইরে আছি। দারুণ একটা বিষয় হলো, আমার আর আরিফের মধ্যে রক্ত সংগ্রহে প্রতিযোগিতা চলে! এমন ভালো ও মানবিক কাজের প্রতিযোগিতা সব সময় চলমান রাখতে চাই।
আমার স্বপ্ন, জীবনে অন্তত ১০০০ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে মরতে চাই। চাওয়া একটাই, রক্তের অভাবে যেন কোনো মানুষ মারা না যায়।
এই তো কিছুদিন আগে মাইলস্টোনের ঘটনায় আঁতকে উঠেছিলাম। আমাদের পক্ষ থেকে কিছুই করার ছিল না। গাজীপুর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে অর্ধশত ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দিয়েছি।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে রক্তদাতাদের উদারতা দেখেছি। বন্ধুসভার বন্ধুদের দেখেছি রাত–দিন রক্তের ডোনার নিয়ে দৌড়াতে। আরিফ, নাসির উদ্দীন, সামিউল, আবিদা, ইতিহাস, পারভেজ, ইসমাইলরা অদম্য। কোথাও আগুন লাগলে কিংবা দুর্ঘটনা ঘটলে চেষ্টা করি অন্তত রক্তটুকু যেন জোগাড় করে দিতে পারি।
এই এক ব্যাগ রক্তদানে কত পরিবারের সঙ্গে যে আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কখনো কখনো রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে টানা দুই দিন নিজের পরিবারের খোঁজ নিতে পারিনি। এই তো সম্প্রতি আম্মার সঙ্গে তিন দিন পর কথা বললাম। এসব করতে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের ক্ষতি হচ্ছে, কাছের লোকেরা পাগল বলছে। এসব পাগলামোর জন্য পছন্দের মানুষ ছেড়ে গিয়েছে; কিন্তু রক্তের যুদ্ধ থামাইনি। আমি বিশ্বাস করি, এই ১১ বছরে যাঁদের রক্ত জোগাড় করে দিয়েছি, সবার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই সম্পর্ক তৈরির কাজটা অব্যাহত থাকবে।
বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা