স্মৃতির মানসপটে বৈশাখ

বৈশাখী মেলায় লেখক। শৈশবকে খুঁজে পাবার চেষ্টা।

ভোর ৫টা বেজে ১৬ মিনিট, ঘুম থেকে খুব কষ্ট করে উঠি। আজ যে করেই হোক সাড়ে ৬টার মধ্যে স্কুলে যেতে হবে। গিয়ে দশটি পুতুল রেডি করতে হবে। এত সকাল সকাল একা যাব ভেবে ভয়ও পাচ্ছিলাম। ভয় থেকেই ভাবলাম ঘরের কিছু কাজ সেরে নিই। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছিল। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, বৈশাখের প্রথম দিনে ফজরের আজান শেষ হতেই গোসলের জন্য বের হয়ে যেতাম মেঘনা নদীর উদ্দেশে। আগের দিন থেকে ছোট ফুফু আর দাদুর সঙ্গে চুক্তি হতো বাড়ির সব পিচ্চিদের।

দাদু বলতেন, ‘ভোরে গাঙে গোসল করে পুরো বছরের পাপ ধুয়েমুছে নতুন জীবন আরম্ভ কুরুন লাগব।’ আরও একটা কথা বলতেন, বৈশাখ মাসের পয়লা দিন তিতা, মিঠা, ঝাল—সব যেন আমরা খাই। একদিন ভালো কাটলে পুরো বছর ভালোই ভালো কাটবে।

নদীতে গোসল সেরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বাড়ি ফিরতাম। ফিরে এসে সব বই–খাতা নিয়ে বসতাম, যেন পুরো বছর ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারি। নস্টালজিয়ায় কত অমলিন সেই স্মৃতি!

ঘড়িতে প্রায় সাতটা বাজতে যাচ্ছে। স্মৃতিচারণা আর কাজ শেষ করে বের হলাম। আরও তিন সহকর্মীসহ শিক্ষার্থীদের পুতুল সাজিয়ে নিয়ে চললাম বৈশাখী মেলায়। ভৈরবে প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ বৃহৎ পরিসরে মেঘনার পাড়–সংলগ্ন তিন সেতুর মিলনস্থানে আয়োজন করে এই মেলা।

ভোরের আলো উঁকি দিতেই আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। তারপর শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আয়োজন। এবার বহু বছর পর মেলায় পা রাখলাম। যাওয়ার ৫ মিনিট বাদেই ঘোষণা হলো, মেলার আকর্ষণীয় পুতুল নাচ নিয়ে আসছে ব্লু-বার্ড স্কুল। আনন্দ ও ভয়ের সংমিশ্রণে বুক ধুকধুক করে উঠল। ‘আইলো আইলো আইলোরে রঙে ভরা বৈশাখ আবার আইলোরে’ গানটিতে পুতুলনাচ পরিবেশনা হয়, সঙ্গে ছিল আরও তিনটি গান।

শৈশবের মতো হাত ধরে দুই ভাইবোনের মেলায় হাঁটাহাঁটি।

পরিবেশনাটি নিয়ে ভয় হওয়ার কারণ মাত্র দুই দিনের মহড়ায় মঞ্চে পারফর্ম করল আমার খুদে শিক্ষার্থীরা। শেষ হতেই মুহুর্মুহু করতালি আর নানান মুখে প্রশংসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে। স্বস্তি পেলাম। আয়োজকেরা আমাদের খৈ-মুড়ির থালি সাজিয়ে দিলেন। শেষ করে ফেরার পালা। অভিভাবকদের সঙ্গে চলে গেল বাচ্চারা। কিন্তু সহকর্মীদের বায়না আধঘণ্টায় মেলায় ঘুরতে চায়। সঙ্গে আমার দুই ভাইও ছিল।

হঠাৎ আনাস হাত ধরে বলে, ‘আপু, মনে আছে ছোটবেলায় হাত ধরে নিয়ে আসতেন। চলেন আজ আমি আপনাকে হাত ধরে নিয়ে হাঁটি।’ আশপাশের কৌতূহলী দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাসতে হাসতে মেলা ঘুরে বেড়িয়েছি দুই ভাইবোন।

আবারও ফিরে গেলাম শৈশবে। টুমটুমি গাড়ি, বিভিন্ন রঙের পানির রকেট, কাঠের ঠেলাগাড়ি, মাটির চুলা, ব্যাংক, হাঁড়ি–পাতিল, পঙ্খিরাজ ঘোড়া, আরও কত শত রঙিন খেলনা ছিল শৈশবজুড়ে। দিনে অন্তত পাঁচবার ছুটে যেতাম বান্নিতে। বৈশাখী মেলাকে তখন আঞ্চলিক ভাষায় বান্নি বলতাম। ‘চল বান্নিতে যাই’ কথাটি এখনো কানে প্রতিধ্বনিত হয়। বর্তমানে মাটির তৈরি জিনিস প্রায় নেই বললেই চলে। উৎসুক চোখে খুঁজছিলাম, প্লাস্টিকের জিনিসের আধিক্যে মাটির জিনিসের চাহিদা যেন কমছে। খুঁজে খুঁজে মাটির কিছু হাঁড়ি, চুলা, পুতুল নিলাম আরও নিলাম খৈ-মুড়ি। এই জিনিসগুলো না হলে মেলা যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। আনাস উপহার দিল এক জোড়া রেশমি চুড়ি।

আধুনিকতার স্পর্শে শৈল্পিক গুণ বেড়েছে। বিভিন্ন অত্যাধুনিক জিনিসও পাওয়া যায়। তবে সেই মৌলিক রং যেন কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। মানুষের মধ্যেও আগের সেই প্রাণ নেই, সবকিছু কেমন যেন যান্ত্রিক লাগে। বৈশাখ রঙিন থাকুক পৃথিবীতে। অসাম্প্রদায়িকতায় আর সাংস্কৃতিক আমেজে মেতে উঠুক প্রতিটি বাঙালির প্রাণ। স্মৃতির মানসপটের ১৪৩২ পয়লা বৈশাখ চিরসজীব থাকবে আজীবন।

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা