মা বলেছিল, একদিন হবে
দুঃখ কী জিনিস, ছোটবেলায় বুঝতাম না। শুধু দেখতাম, বাবা কাজ থেকে ফিরে বসে থাকেন নিঃশব্দে। মা নিজের গায়ের শাড়ি কাটতে কাঁপা হাতে বসেন, যেন কিছুই হয়নি। সেই বয়সে বুঝতাম না, অভাব কাকে বলে। বুঝতাম না, ভাঙা ঘরের নীরবতা কেন এত ভারী!
তবে একটা বিষয় বুঝতাম, মায়ের মুখের হাসিই আমাদের একমাত্র সুখ। লেখাপড়ার হাতেখড়ি মায়ের হাতে। স্কুলে যাওয়ার আগেই শিখেছিলাম বর্ণমালা, ছড়া, দোয়া, সুরা। মা পাশে বসে রাত জেগে পড়াতেন। তাঁর চোখে একটাই স্বপ্ন—ছেলে একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে।
শুরুটা ভালোই ছিল। পিএসসিতে ভালো ফল, গ্রামের মানুষের প্রশংসা। কিন্তু মাধ্যমিকে গিয়ে পথ হারাই। বন্ধু, ভুল সঙ্গ আর অনিয়ম—আমার দিকে আঙুল উঠল। মাকে অপমান সহ্য করতে হলো। এক মুরব্বি বলেছিলেন, এই ছেলেকে দিয়ে কিছু হবে না। সেই রাতে মা চুপচাপ কেঁদেছিলেন। কান্নার শব্দ আমার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিল। জেএসসিতে গোল্ডেন এ+ পেলাম। স্বপ্ন ফের জেগে উঠল।
তারপর দিন বদলাতে লাগল। এসএসসি, এইচএসসি পেরিয়ে শহরে এলাম পড়াশোনার জন্য। মা ভয়ে, শঙ্কায় ভরা চোখে আমাকে বিদায় দিলেন। প্রতিবার লঞ্চঘাটে মা দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতক্ষণ না লঞ্চ চোখের আড়াল হয়ে যায়।
ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করলাম। তখন এক চায়না প্রজেক্ট থেকে চাকরির প্রস্তাব এল। ভালো বেতন, নিশ্চিন্ত জীবন। মাকে জানালাম, ‘চাকরি নিচ্ছি। তোমাদের কষ্ট কমবে।’
মা বললেন, ‘আমাদের ভরণপোষণ লাগবে না, বাবা। তুই সরকারি কর্মকর্তা হলেই সব কষ্ট শেষ হবে। তোর বাবার স্বপ্ন তুই পূরণ কর।’ মায়ের সেই চোখভরা কথা আমার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কীভাবে বোঝাই, আমি তো আসলে ভেতরে ভেতরে একটা প্রশ্নে দগ্ধ হচ্ছিলাম—আমি কি পারব?
২০২৩ সালের শেষ দিকে যুদ্ধ শুরু করলাম। এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউক, রেলওয়ে, ভূমিসহ সব জায়গায় পরীক্ষা দিচ্ছি। প্রথম দিকে লিখিত পার হতাম, কিন্তু ভাইভায় ফেল। কখনো প্রিলি পার, তো লিখিত ফেল। এমনও সপ্তাহ গেছে যে তিন-চারটা পরীক্ষা দিয়েছি। গোল্লা ভরেছি, চোখ ভরেছে পানিতে, কিন্তু ভাগ্য ভরেনি।
বন্ধুরা দূরে সরে গেছে, পরিবার চুপচাপ। কারণ, সবার মনে প্রশ্ন একটাই, ‘কী করিস?’ প্রশ্নটা ছুরির মতো লাগে। বাড়িতে থাকতে দিনের বেলায় বাইরে যেতাম না। সন্ধ্যার অন্ধকারে হেঁটে বেড়াতাম, যেন কেউ চিনতে না পারে। বেকার ছেলেদের যেন সমাজে কোনো জায়গা নেই। এই জীবন বড় নিঃসঙ্গ, বড় তিক্ত। ভালোবাসার মানুষটাও একসময় চলে যায়। তখন শুধু থাকি আমি, আমার ব্যর্থতা আর চোখ বেয়ে পড়তে না চাওয়া কান্না।
রাতে ঘুম আসত না। ওয়েবসাইটে ফলাফল খুঁজি, একটা সুসংবাদের আশায়। একদিন যদি মাকে বলতে পারি, তোমার কষ্ট শেষ, আমি পেরেছি!
অবশেষে সেই দিন এল। ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল, ২১ রমজান। চূড়ান্ত ফল প্রকাশ। সেদিন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে, রাজস্ব খাতে, মেধাক্রম ৩-এ সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম। তিনবার নিজের রোল নম্বর মিলিয়ে দেখেছি। ভুল তো নয়? না, এইবার সত্যি আমি পেরেছি।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফোন করলাম মাকে; ‘মা শুনছ, চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি। এবার তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।’ ওপাশে মা চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর কাঁপা গলায় বললেন, ‘বাবা, চোখের পানি তো আর আটকে রাখা যায় না। আলহামদুলিল্লাহ!’
সেদিন বুঝলাম, এই চাকরি কেবল আমার নয়। এই চাকরি মায়ের দোয়ার ফসল, বাবার দিনের পর দিন না খেয়ে ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফসল, আমার একলা রাতের কান্নার ফসল।
এরপর একে একে আরও চাকরি পেলাম। ২০২৫ সাল আরও বড় এক আশীর্বাদ হয়ে এল আমাদের পরিবারের জন্য। মে মাসের শেষ দিকে মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে ৩টি চাকরির নিয়োগপত্র হাতে পেলাম—ভূমি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। বাংলাদেশ রেলওয়েতেও সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম।
খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসা। আমার কাছে এখনো রূপকথার গল্পের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি সরকারি ভবনের করিডরে। গলায় ঝুলছে সেই পরিচিত আইডি কার্ড—লোগো দেওয়া সেই পরিচয়পত্র, যার স্বপ্ন একসময় আমার মা–বাবা দেখতেন। এই যে মায়ের চোখে হাসি, বাবার মুখে গর্ব, এটা পাওয়ার জন্যই তো এত দিন লড়েছি।
তবে যুদ্ধ কি শেষ? না। বাবার স্বপ্ন এখানেই থেমে নেই। আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবু আজ বুক ভরে বলতে পারি, ‘মা শুনছ, তোমার ছেলে অবশেষে চাকরিটা পেয়ে গেছে।’
কর্মকর্তা, ভূমি মন্ত্রণালয়