বাবা চাইতেন তাঁর সন্তানেরা শিক্ষাবান্ধব সমাজে বেড়ে উঠুক
আমার বাবা মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম খান (মালা স্যার)। তিনি ১৯৫০-১৯৬০ সালে ইডেন মহিলা কলেজ, ১৯৬০-১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ, ১৯৭০ সালের প্রথম দিকের ৬ মাস চিটাগাং গভ. কলেজের গণিতের প্রফেসর ছিলেন। তিনি ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ‘শ্রেষ্ঠ গণিতের শিক্ষক’ গোল্ড মেডেল পান। ১৯৭০ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়টাতে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে ওখানেই অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালের শেষে ‘ইন্সপেকশন অ্যান্ড অডিট’–এর স্কুল শাখায় ‘জয়েন ডিরেক্টর অব এডুকেশন’ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
চাকরির সুবাদে আবাসিক বাসস্থান হিসেবে বেইলি রোড নীহারিকায় বরাদ্দ পেয়েও বাবা সেই জায়গা ছেড়ে আমাদের নিয়ে উঠেছিলেন আজিমপুর কলোনিতে। যেন তাঁর সন্তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজসহ আরও সব প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজের শিক্ষকের সন্তানদের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। হয়েছেও তাই। আমরা ভাইবোনেরা সম্পূর্ণ স্কুল আর কলেজ সময়টায় হেঁটে হেঁটে পদব্রজেই সব শিক্ষকের বাড়ি বাড়ি জ্ঞানার্জন করে বেড়িয়েছি।
বাবার হাতে ছিল বাংলাদেশের যাবতীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষা পরিকল্পনা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কার্যকলাপ, দেখাশোনা এবং অদল-বদল বা বদলির অনেক কিছুই। ছোট ছিলাম, বুঝতাম কম। একজন সৎ শিক্ষক বাবার সন্তান হিসেবে আমাদের চার ভাইবোনের সংসারে হয়তো কিছুটা টাকাপয়সার স্বল্পতা ছিল; কিন্তু সুখ-শান্তি আর হাসি-আনন্দের অভাব ছিল না কখনো। সবার ঘরে যখন রঙিন টিভি চলে এসেছিল, তখন আমার পরিবারের সবাই টেপরেকর্ডার, রেডিও দুর্বার গান ইত্যাদি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকত। তিনতলা আর পাশের বাসার প্রতিবেশীরা আমাদের ডেকে নিয়ে যেতেন ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’, ‘বায়োনিক ওম্যান’ ইত্যাদি দেখার জন্য। তা-ও আবার এমনভাবে যাতে আমার বাবা টের না পান। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেন টিভি কিনে দিতেন না, সে জন্য রাগ হতো আমাদের। প্রায়ই মনে হতো, এমন কষ্ট দেয় কেন বাবা?
সে সময়ে বাড়িতে বাবার চাকরির সুবাদে কমলা রঙের একটা সরকারি ল্যান্ডফোন এসে জুটেছিল। সেটায় আবার ছোট্ট একটা তালা লাগানো থাকত। আমরা জানতাম ওটা সরকারি জিনিস, সরকারি কাজ ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। কত দিন আমার শিশুর মতো সহজ–সরল মাকে দেখেছি বাবাকে অনুরোধ করে যাচ্ছেন, ‘শুধু একটা ফোন করে মার খবরটা নেব।’ আমার বাবা এত নাছোড়বান্দা ছিলেন যে রাজিই হতেন না। সবাই তখন আম্মুর জন্য গাল ফুলিয়ে থাকতাম। আশপাশের অনেকের বাসাতেই তো এভাবে ফোন এসেছিল। তারা তো ব্যবহার করে যাচ্ছে! বাবা কেন দিচ্ছে না?
তখন চারপাশে শুরু হয়েছিল রমরমা ঘুষের বন্যা! বাবা প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে রাগে-দুঃখে গজগজ করত। কত দেখেছি, উপচে ভরা আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল আর বিশাল সাত-আট ফুটি মাছে ভরা ঝাঁকা নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন চাকরির বদলি বা অন্য কোনো অন্যায় আবদার নিয়ে আমাদের দরজায় হাজির হতে। বাবাকে তখন অন্য রূপে দেখতাম। বোঝাতে বোঝতে একসময় চিৎকার করে উঠত বাবা, ‘বাড়ির লোকজনকে এত বড় মাছ খাওয়াইছেন কখনো? কার কাছে শুনেছেন এমন করে বাড়ি বয়ে জিনিসপত্তর আনলে আপনাদের কাজ হয়ে যাবে! তাড়াতাড়ি এগুলো নিয়ে যান। বাড়িতে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের খাওয়ান।’
লোকজন চাইত কোনোরকমে দরজা ঠেলে ওসব ঢুকিয়ে দিতে, ইশারায় আমাদের বলতে থাকত ‘রাখো সোনা’। লোকটার বাড়াবাড়িতে বাবা যখন ভয়ানক রেগে যেতেন, ভয়ে তখন সে লোক দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের কলোনির দোতলা বাসার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে রিকশায় উঠে বসতেন। বাবাও হেরে যাওয়ার লোক ছিলেন না। ঝাঁকাসুদ্ধ সবকিছু নিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে খোলা বারান্দা থেকেই ওই লোকের রিকশার পেছনেই ওসব ছুড়ে ফেলতেন। ওই লোক তখন রিকশা থেকেই পেছন ফিরে হা করে মাথায় হাত দিতেন। আশপাশের পথচারী, পথশিশু, ভিখারি সব ছুটে আসত। ওভাবেই ওদের ভোজ হতো মাঝেমধ্যে। আমরা ওপর থেকেই বড় বড় চোখ করে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। কত খাবার নষ্ট হতো! বাবার ওপর রাগ হতো খুব।
পরীক্ষায় রেজাল্টের সময় হলেই বাবাকে দেখে তাঁর ছাত্রছাত্রী, আত্মীয়স্বজন সব ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিত। তাঁদের অনেকেই আজ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছেন। রাগ থাকলেও বাবা ভেতরে ভেতরে ছিলেন অনেক মাটির মানুষ, অতিথিপরায়ণ।
স্থাপত্য বিভাগে পড়তাম। হয়তো বাবাকে বলেছি—‘টাকা লাগবে ক্লাস প্রজেক্টের জন্য।’ তিনি প্রথমেই বলতেন, ‘টাকা নেই!’ আমি চুপ করে থাকতাম। পরে দিয়ে আবার বলত, ‘টাকাপয়সা নষ্ট করবি না।’
‘কোথায় নষ্ট করব?’
শেষে যা চাইতাম আরও বেশি হাতে গুঁজে দিয়ে বলত, ‘যা লাগে কিনে ফেল আর দেখ, ক্লাসের অন্য কারও কিছু লাগে কি না!’ আমি বলতাম, ‘প্রথমে কেন না করলা তাহলে?’ বাবা হাসত, ‘মা-রে বেশি বিলাসিতা ভালো না। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু আসল কথা হলো ঠিকভাবে চললে অভাবে স্বভাব গোছানোও যায়।’
আমার এই মাটির মানুষ বাবা ২০০৫ সালে আমার কাছেই মারা গিয়েছিলেন। মা তিন মাসের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন বোনের কাছে বেড়াতে, ভাইরাও সব ওখানেই ছিল। তখন আমি ছিলাম পরিবার নিয়ে বাবার কাছেই। আম্মুর জন্য অনেক অনেক বাজার করে নিজেই রান্না করেন। আম্মু দেশে ফেরার ঠিক আগের দিন অসুস্থ হয়ে বারডেমে ভর্তি হন এবং মারা যান। কত কত মানুষ বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়ি এসে বলে গেছেন যে তাঁদের বিপদের দিনে বাবা নীরবে পাশে ছিলেন। এটাই হয়তো একজন প্রকৃত সৎ শিক্ষক মানুষের সারা জীবনের একমাত্র চাওয়া।
আজ বাবা দিবস, শুধু এই দিবসের জন্য নয়, সব সময়ের জন্যই বাবাকে কিছু কথা কখনো বলা হয়নি। আজ বলতে চাই—বাবা, তোমার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। তুমি ছাড়া আমরা ভাইবোনেরা কেউই প্রকৃত মানুষ হতে পারতাম না। কত দিন কত কিছুতে তোমার ওপর মন খারাপ করেছি। তখন ছোট ছিলাম। মনে মনে অনেক শিশুসুলভ রাগই হতো। বড় হওয়ার পর এখন সব বুঝি। তোমার আলোকেই এখন সন্তান মানুষ করার চেষ্টা করি। তোমার কাছ থেকেই আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখেছি। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে কোর্টের জজ, দোকানদার, ঘরের সাহায্যকারী—সবাই মানুষ। কেউ কোনো অংশে কম নয়।