বান্দরবান ও কক্সবাজার, বাইকে এক দুঃসাহসী যাত্রা

বান্দরবানের অপরূপ সৌন্দর্যছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে রাতে যেমন নির্জন, তেমনি থাকে ট্রাক ও বড় গাড়ির দাপট। সেদিন রাত ১১টায় বান্দরবানের উদ্দেশে যখন বের হই, তখন এই ধারণা ছিল না। তবে দীর্ঘ পথ বাইক রাইড করার সময় ঘুম যেন না পেয়ে বসে, সে জন্য যাত্রাপথে আমরা বেশ কয়েকবার বিরতি নিই। বিরতিতে চা, বিস্কুট, এটাওটা খাই।

সম্পূর্ণ যাত্রাপথে আমরা দুই বাইক সব সময় পাশাপাশি অবস্থান করেছি। কেউ একটু এগিয়ে গেলে আরেকজন অপেক্ষা করেছি। যেন কোনো বিপদ এলে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে পারি। ফলে মনে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও আত্মবিশ্বাস একেবারে কম ছিল না। বোধ করি, এই ভাবনা আমাদের যাত্রাকে নিরাপদ করেছে। তবে বাইকভ্রমণের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত। যেমন দীর্ঘ পথে রাতে একা বাইক নিয়ে বেরোনো বুদ্ধিদীপ্ত কাজ নয়। এ ধরনের যাত্রার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দুই থেকে পাঁচটি বাইক থাকা ভালো। এতে যেমন নিরাপত্তার ঝুঁকি কম থাকে, পাশাপাশি মনের মধ্যে সাহসও আসে। সেই সঙ্গে ব্যাগে অবশ্যই পর্যাপ্ত পানি রাখতে হবে।

পথটা ভয়াবহ—উঁচু-নিচু পাহাড়, মেঘে ঢাকা আকাশ।

সাজ্জাদ ও মেরাজ অনেক সাপোর্ট করেছে এই যাত্রায়। তাঁরা যদিও বয়সে আমার ছোট, কিন্তু সম্পূর্ণ যাত্রায় সেটা বুঝতে দেয়নি। তাঁদের সঙ্গ যাত্রাকে সহজ করেছে। আমরা যখন চট্টগ্রাম পৌঁছাই, ঘড়িতে তখন ভোর ৪টা বেজে ৩০ মিনিট। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু করি বান্দরবানের উদ্দেশে। সকাল সাতটায় পৌঁছাই বান্দরবান। সকালের নাশতা সেরে নীলাচলে যাই। নীলাচলের অপরূপ সৌন্দর্যে ডুব দিই। এই পাহাড় থেকে পুরো বান্দরবান শহরটা দেখা যায়। অপরূপ সুন্দর দৃশ্য, যা চোখে না দেখলে বর্ণনা করা মুশকিল।

এরপর রওনা দিই থানচির উদ্দেশে। বান্দরবান শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে থানচি অবস্থিত। পথটা ভয়াবহ—উঁচু-নিচু পাহাড়, মেঘে ঢাকা আকাশ। মাঝেমধ্যে ভয় হচ্ছিল। কারণ, থানচি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল, ফলে খোলা হওয়ায় আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম। পথে চিম্বুক পাহাড় আর ডিম পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করি। চিম্বুক পাহাড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। পাহাড়ি বাতাসে ক্লান্ত শরীর ঝিমিয়ে যাচ্ছিল, আর পাশের আমের বাগানে মিষ্টি আম খেতে খেতে প্রকৃতির অপরূপ শোভা উপভোগ করছিলাম।

বান্দরবানের অপরূপ সৌন্দর্য। মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি।

ডিম পাহাড়ে যাওয়ার পরপর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। মেঘ নেমে আসে, ঝিরিঝিরি পানি শরীর ভিজিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি। এরপর থানচির পথে আবার যাত্রা শুরু।

দীর্ঘ সময় বাইক চালানোর কারণে ব্রেকের ডিস্ক গরম হয়ে যাওয়ায় ব্রেক করা কঠিন হয়ে পড়ে। কয়েকবার ব্রেক ফেল হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। একে তো পাহাড়ি রাস্তা, সেই সঙ্গে যান্ত্রিক সমস্যা ভয় ধরিয়ে দেয়। ইঞ্জিন ব্রেক ব্যবহার করে গাড়ি ধীরে ধীরে থামাই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ডিস্কে ঠান্ডা পানি দিয়ে গরম কমানোর চেষ্টা করি। ব্রেক ঠিক করে আবার যাত্রা শুরু করি।

বান্দরবান থেকে থানচি আসতে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। আমরা বিরতিহীন যাত্রা শুরু করি আলীকদমের উদ্দেশে। যখন আমরা আলীকদমে পৌঁছাই, তখন প্রায় সন্ধ্যা। আর পাহাড়ি রাস্তায় একটু আগেই যেন অন্ধকার নামে, তার ওপর বৃষ্টি। পুরো এলাকা নিস্তব্ধ।

পাহাড়ি রাস্তায় একটু আগেই যেন অন্ধকার নামে, তার ওপর বৃষ্টি।

আমরা দুই বাইক নিয়ে সেখান থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। রাতে পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করা দুঃসাহসিক এবং ভয়াবহ কাজ। বিকট শব্দ, বৃষ্টি আর অন্ধকার মিলিয়ে যাত্রা কঠিন হয়ে ওঠে। আমরা রাত সাড়ে সাতটায় ফাঁসিয়াখালী পৌঁছাই। পাহাড়ি রাস্তা প্রায় শেষ হয় সেখানে।

মুষলধারে বৃষ্টি আর অন্ধকার রাস্তা পাড়ি দিয়ে আমরা রাত সাড়ে নটায় পৌঁছাই কক্সবাজার। ক্লান্ত শরীরে একটি হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নিই।

পরের দিন সকালে নাশতা সেরে ইনানী বিচের উদ্দেশে রওনা দিই। এই পথেই মূল সৌন্দর্য মেরিন ড্রাইভ রোড। অপরূপ সুন্দর এই রাস্তা আর তার বুকে বাইক চালানোর সময় পাশে ছিল বিশাল সমুদ্র আর গর্জন করা ঢেউ। বাইক চালাচ্ছি আর সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে—এই অনুভূতির কোনো তুলনা হয় না। এমন মনোমুগ্ধকর শান্তি লিখে বোঝানো কঠিন। এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা ইনানী বিচে পৌঁছাই।

বাইক চালাচ্ছি আর সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে—এই অনুভূতির কোনো তুলনা হয় না।

সমুদ্রের ঢেউ আর পানি দেখে আটকে রাখতে পারি না নিজেদের। নেমে পড়ি পানিতে। মুহূর্তেই পাহাড়ি পথের ক্লান্তি যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে মিলিয়ে যায়। ঠান্ডা শরীরে লেগে মনটা যেন হালকা হয়ে ওঠে। পাহাড়ের বন্ধুর পথ আর বৃষ্টিমুখর রাতের পর শান্ত সমুদ্র যেন নতুন করে বাঁচার শক্তি দেয়।

সমুদ্রসৈকত ঘুরে সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই আমরা। প্রায় ৪২০ কিলোমিটার পথ—তার ওপর বৃষ্টি, রাত আর ক্লান্তি মিলে ঢাকা যাত্রা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ভোরের দিকে আমাদের দুজনেরই বাইক চালাতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। একদিকে দীর্ঘ পথ, অন্যদিকে ঠান্ডা লাগছিল, সেই সঙ্গে আশপাশের দোকান খোলা ছিল না। ফলে আমরা ঠিকমতো বিশ্রামও নিতে পারিনি। ভোররাতে চোখে ঘুম লেগে যাচ্ছিল। এটি ছিল পুরো যাত্রার সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত—ঘুম চোখে বাইক চালানো কখনোই উচিত নয়, যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই বারবার বিরতি নিই, একে অপরকে সতর্ক করি, নিজেরা নিজেদের উৎসাহ দিই—‘আরেকটু বাকি, সাবধানে, ধীরে ধীরে এগোও’—এভাবে এগিয়ে যাই। অবশেষে সকালে আমরা নিরাপদে ঢাকা পৌঁছাই।

মুহূর্তেই পাহাড়ি পথের ক্লান্তি যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে মিলিয়ে যায়।

যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি বান্দরবান যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। নন-এসি বাসের ভাড়া ৯০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে, আর এসি বাসের ভাড়া ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এরপর বান্দরবান পৌঁছে চাঁদের গাড়ি করে আশপাশ ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে পারেন। যেহেতু বান্দরবানের রাস্তা উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা। তাই এসব রাস্তার জন্য চাঁদের গাড়িই সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। ভাড়ার বিষয়ে চিন্তা করার কিছু নেই—প্রায় সব জায়গায়তেই নির্দিষ্ট ফিক্সড রেট নির্ধারিত থাকে।

সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা