পথের বাঁকে জীবন, আঁধারে তাকিয়ে স্বপ্নের খোঁজ

প্রতীকীছবি: সাদ্দাম হোসেন

বেলা তিনটে ছুঁই ছুঁই। বাইরে তখনো ঝিরঝির বৃষ্টি আর বাতাসের এক অদ্ভুত সুর। আমি একটি টংদোকানের সামনে দাঁড়িয়ে শহরের মানুষ দেখছি। বসে থাকা মানুষ, হাঁটতে থাকা মানুষ। হাসতে থাকা মানুষ, কাঁদতে থাকা মানুষ। লাফিয়ে চলা মানুষ, ঝিমুতে থাকা মানুষ। চিৎকার করা মানুষ, চুপচাপ চলা মানুষ। রাস্তার ধারে ঘুমিয়ে থাকা মানুষ, হনহন করে ছুটে চলা মানুষ। কড়া প্রসাধনী মেখে সং সাজা মানুষ, আবার লাল চুড়ির সঙ্গে নীল শাড়িতে স্নিগ্ধ কোনো মানুষ।

এতক্ষণ ২ নম্বর বাসের অপেক্ষায় ছিলাম, শেষমেশ তার দেখা। বাসে উঠে স্থবির নগরীর রাজপথে চলা যানবাহনের মানুষ দেখছি। ভেজা শহরের ভিড়ে কেউ বসে, কেউ ঝুলে, কেউ দাঁড়িয়ে হেঁটে চলে ক্লান্ত জীবনের পথে। বৃষ্টিতে ভেজা একেকটা মুখ যেন নীরব গল্প বলে।

আরও গভীরেও তাকাই, আর দেখি—সিটিং নামক লোকাল বাসের রড ধরে ঝুলতে থাকা মানুষের চোখের পলক, ঠিক তারই পাশে দাঁড়ানো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পাজেরো গাড়ির বাষ্প জমা গ্লাস, বাস স্টপেজে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী মানুষটির কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম, রিকশার প্যাডেলে দ্রুত পা চালানো মানুষটির কষ্ট, কিশোরীর আঙুলে ঝুলতে থাকা টিফিন বাটির দোলন, টাকার যন্ত্রের পাহারাদারের খাকি রঙের জামা, দুই হাত ভরে শপিং করা চুলরাঙানো নারী, গোলাপ হাতে গাড়ির কাছে ছুটে যাওয়া শিশুর আকুতি, রিকশায় বসা মেয়েটির চুল ঠিক করে দেওয়ার নামে ছুঁয়ে ফেলা প্রেমের ছোঁয়া, ফুটপাতে ভিক্ষারত মায়ের কোলের শিশুর অবাক চাহনি। সবকিছুই মনে করিয়ে দেয় এই শহরের প্রতিদিনের জীবন চিত্র।

এসবের মধ্যে আমি স্বপ্ন আবিষ্কারের অভিযানে নামি। খুঁজে পাই কত আশার বাতি। অফিসফেরত ক্লান্ত মানুষের ঘামে প্রতিফলিত হয় রঙিন স্বপ্ন। টিফিন দোলানো কিশোরীর আঙুলের ভাঁজে থাকে স্বপ্নের বসতি। টোকাই শিশুর বস্তায় জমে ওঠে স্বপ্নের চিঠি। চোখের মধ্যে স্বপ্ন আঁকে প্রেমিক–প্রেমিকা। আর ভিক্ষারত মায়ের কোলের শিশু আঁকড়ে ধরে তার জীবনের একমাত্র স্বপ্নটিকে।

চলতে চলতে হঠাৎ সব আলো ঢেকে যায় কালো কাচে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিভে গেল তা–ও। বাসের জানালা খুলে কোনাকুনি ওপরে দৃষ্টি দিলাম। একটুকরা আকাশের দেখা পেলাম। সেখানে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের চমক। গাছের পাতাগুলো তখনো স্নানে। নাগরিক ধুলা মুক্তির সাময়িক আবেশে উচ্ছ্বসিত। এদিকে মেঘের আওয়াজ বৃষ্টির কলতানে ঢাক বাজাচ্ছে যেন।

অবশেষে হেলপারের কণ্ঠে ভেসে আসে আমার গন্তব্যের নাম। বাস থেকে নামতেই আবার বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির শুরু। দৌড়ে একটা টংদোকানের ছাউনিতে যেতে না যেতে ভিজে গেলাম খানিকটা। আর দাঁড়িয়ে কী হবে, ধুর! এমনিতেই শরীর জ্বরে কাহিল, তার ওপর এই বর্ষাস্নান। ভাবতে ভাবতে বাসার পথ ধরলাম। জল ও কাদায় মাখামাখি হয়েই বাসায় ঢুকতে হলো। বারান্দা থেকে গামছা নিয়ে মাথা মুছতে মুছতেই বসে পড়লাম বিছানায়। ক্লান্ত লাগছে। চারদিকে আঁধারে ছেয়ে গেছে। আমি আঁধারে তাকাই, স্বপ্ন খুঁজি। আর প্রশ্ন করি, নিজেকে কি বুঝি?