এ যুগের শান্তিনিকেতন

দিনাজপুরের দীপশিখা মেটি স্কুল
ছবি: লেখক

দিনাজপুরের দীপশিখা মেটি স্কুল নিয়ে নানা কথার ফুলঝুরি শুনতে শুনতে কৌতূহল জাগল স্কুলটা ঘুরে দেখার। অবসরে কয়েকজন মিলে বেরিয়ে পড়লাম দিনাজপুরের পথে। ময়মনসিংহ থেকে আগের রাতে বাস ধরে যাত্রা। যতক্ষণে দিনাজপুরে পৌঁছালাম, ততক্ষণে রাত পোহাতে বাকি রইল না। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুর হলে যাত্রাবিরতির পর ক্যাম্পাসের সামনে টং দোকানের এক কাপ চায়ে স্বস্তির ছোঁয়া নিয়ে আবার যাত্রা বিরলপুরের দিকে।

দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে এই স্কুল। যাত্রাপথে ছিল গ্রামীণ পরিবেশের অনন্য ছোঁয়া ও মনোরম পরিবেশের আঁকাবাঁকা রাস্তা। অতঃপর কাঙ্ক্ষিত সেই স্কুলে পৌঁছালাম।

কৃষ্ণচূড়াগাছের বেষ্টনীর প্রবেশদ্বার দিয়ে দীপশিখার সাদামাটা ফটক ভেদ করে ঢুকতেই নজর আটকে যায় প্রকৃতির ছোঁয়ার মতো একটা পরিবেশে। অনেকেই ‘থ্রি-ইডিয়টস’ মুভি দেখেছেন, ছবি ক্রিয়েশনের প্রতিটি স্পর্শে ছিল নান্দনিকতা! দীপশিখা মেটি স্কুল যেন ‘থ্রি-ইডিয়টস’ মুভির বাংলা ভার্সনের বাস্তব রূপ!

গাছগাছালিতে ঢাকা, বাঁশ-বেত আর পলিমাটি দিয়ে গড়া এ স্কুলটি যেন শান্তির নীড়। এখানে বাচ্চারা পড়ে মনের আনন্দে, শেখে হাতে-কলমে প্রকৃতির ছায়ায়।

স্কুলটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রাপুর গ্রামে অবস্থিত। অনগ্রসর রুদ্রাপুর গ্রামের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তুলতে ‘দীপশিখা’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘মেটি স্কুল’ গড়ে তোলে। বর্তমান স্থাপনাটির নির্মাণ শুরু হয় ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি স্থায়ী ও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষা গ্রহণ—এ সবই স্কুলটির প্রধান উদ্দেশ্য।

দীপশিখা মেটি স্কুল প্রাঙ্গণে লেখক ও তাঁর বন্ধুরা।

এখানে শিক্ষার্থীদের নাচ-গান-অভিনয়-চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা ও কথোপকথনভিত্তিক ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে। বর্তমানে এই স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করানো হয়। মেটি কেবল একটি সংগঠনের নাম নয়, প্রকল্পের নামও। পুরো নাম মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি)।

দীপশিখা মেটি স্কুলের খ্যাতি এর ভিন্নধর্মী নির্মাণশৈলীর জন্য। এটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ ইত্যাদি। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল। ভিত ছাড়া অন্য কোথাও ইটের ব্যবহার নেই। দেয়ালের ভিতের ওপর দেওয়া হয়েছে আর্দ্রতারোধক। দেয়ালের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের প্লাস্টারে পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রুফ। ৯ ফুট উচ্চতার ওপরে প্রথম তলায় ছাদ হিসেবে বাঁশ বিছিয়ে ও বাঁশের চাটাই দিয়ে মাটির আবরণ দেওয়া হয়েছে। ওপরে বৃষ্টির পানির জন্য দেওয়া হয়েছে টিন। মেটি স্কুল ছয় কক্ষবিশিষ্ট মাটির তৈরি একটি দোতলা ভবন। এর আয়তন আট হাজার বর্গফুট। ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭ লাখ টাকা।

দীপশিখা মেটি স্কুল
ছবি: লেখক

দ্বিতল এ স্কুলের বৈশিষ্ট্য হলো, কক্ষে শিক্ষার্থীরা গরম-শীতের অনুভূতি তীব্রভাবে অনুভব করে না। আলো-বাতাসের আগমনে স্বাস্থ্যও ভালো থাকে এবং কক্ষগুলোও পরিবেশবান্ধব।

২০০২ সালে রুদ্রাপুর গ্রামে গবেষণার কাজে অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যানা হেরিঙ্গারসহ (Anna Heringer) আরও কিছু শিক্ষার্থী আসেন। গবেষণা শেষে অন্যরা ফিরে গেলেও অ্যানা হেরিঙ্গার তাঁর গবেষণা ও স্থাপত্যবিদ্যা কাজে লাগিয়ে রুদ্রাপুরের অনুন্নত শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের লক্ষ্যে একটি স্কুল বানানোর পরিকল্পনা করেন। তাঁর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে জার্মানির উন্নয়ন সংস্থার আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশের বেসরকারি সেবা সংস্থা দীপশিখা।

মাটি, বাঁশ, খড়, দড়ি, বালু, কাঠসহ প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে বানানো আনন্দালয়ের স্থাপত্যশৈলী বৈচিত্র্যময় ও অপূর্ব। এটি নকশা করার জন্য ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ওবেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বিখ্যাত জার্মান স্থপতি আন্না হেরিঙ্গার। একই উপকরণ দিয়ে গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেটি স্কুলের সুবাদে ২০০৭ সালে তিনি পেয়েছিলেন আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড। পুরস্কার হিসেবে দীপশিখাকে ১৩ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার, আর্কিটেক্ট আন্না হেরিঙ্গারকে ১৬ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার ও আর্কিটেক্ট আই কে রোজওয়ার্গকে ৮ হাজার ২০০ ডলার দেওয়া হয়।

স্কুলের ক্লাসরুমের ভেতরের স্ট্রাকচার গোল শেডের মতো
ছবি: লেখক

সম্পূর্ণ মাটির স্কুলটির শিক্ষার্থীরা মেধা ও মননের দিক দিয়েও অনন্য! এখানকার বাচ্চারা প্রয়োজনের অবশিষ্ট পানি কখনো খোলা স্থানে ফেলে না, বরং গাছের গোড়ালিতে ঢেলে দেয়। এটি ছোট্ট একটা বিষয় হলেও অনেক বড় একটি চর্চা! বাচ্চাদের জন্য এখানে মধ্যাহ্ন ভোজনালয় আছে একটি, যেখানে সবাই গিয়ে একসঙ্গে মেঝেতে বসে খাবার খায়, যা দারুণ হৃদ্যতার প্রমাণ। দুপুরের খাবার শেষে বিদ্যালয়ের একটি কর্নারে ঘুমের ব্যবস্থাও রয়েছে। যেখানে তালপাতার মাদুরে সবাই শুয়ে ঘুমায় এবং দায়িত্বরত একজন শিক্ষক ঘুম পাতিয়ে দেন।

স্কুলের ক্লাসরুমের ভেতরের স্ট্রাকচার গোল শেডের মতো, যেখানে বসে প্রত্যেক শিক্ষার্থী একে অপরকে মুখোমুখি দেখতে পারে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ক্লাসরুমসহ ফিজিওথেরাপি সেন্টারও রয়েছে।

চমৎকার অনন্য পরিবেশের স্কুলটি ঘুরে বের হওয়ার সময় একরাশ মুগ্ধতা গ্রাস করল। মাথায় একটি কথাই ঘুরছিল, এটি শুধু একটি স্কুলই নয় বরং এ যুগের শান্তিনিকেতন।

বন্ধু, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা