বয়স তখন দশ। ক্লাস ফোরে পড়ি। স্কুল শেষে বাসায় ফিরতাম একা। বাবা-মা দুজনই চাকরিজীবী। বাবা প্রতিদিন আমাকে স্কুলে নামিয়ে অফিসে যেতেন। আর আমি বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবার ফোন আসত। জানতে চাইতেন, ফ্রেশ হলাম কি না, কিছু খেলাম কি না, পরীক্ষার খাতা ফেরত পেলাম কি না, আর নম্বর কম পেলে যেন মন খারাপ না করি—এসব একনিশ্বাসে জানতে চাইতেন। সেই ছোট্ট ফোনকলেই যেন বাবা তাঁর সারা দিনের ভালোবাসা ঢেলে দিতেন।
দুপুরে যখন ঘুমাতাম, বাসায় ফিরে বাবা হাতে করে নিয়ে আসতেন প্রিয় ক্যান্ডি, ম্যাজিক বল কিংবা আঁকিবুঁকির খাতা। ঘুম ভাঙার পর সেসব পেয়ে মনটা ভরে যেত আনন্দে। প্রতি বৃহস্পতিবার থাকত ঘুরতে যাওয়ার বায়না। কারণ, পরদিন ছুটি। বাবা সেই বায়নাও রেখেছেন প্রতিবার। মা যেন দুপুরে আমার পছন্দের মাছটা ভাজেন, তা নিয়েও বাবার চিন্তা ছিল। কোথাও আমাকে একা যেতে হলে বারবার ফোন দিতেন।
সময় পেরিয়ে গেছে, বয়স বেড়েছে, কিন্তু বাবার ভালোবাসা একটুও বদলায়নি। ছোটবেলায় জ্বর হলে বাবাকে ডেকে উঠতাম, আজও সেই ডাকেই ভরসা খুঁজি। সেদিন রাতে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় নিজের রুম থেকে বাবাকে ডাকলাম। তিনি ছুটে এলেন, ওষুধ খাওয়ালেন, সকালে উঠে আবার জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগছে। খাওয়া ঠিকমতো না করার জন্যই এমন হচ্ছে কি না, সে নিয়েও চিন্তিত ছিলেন।
আচ্ছা, বাবা কি জানে আমি তাঁকে কতটা ভালোবাসি? অফিস থেকে দেরি করে ফিরলে এখনো বুক ধকধক করে। বাবার ফোন না পেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কেউ যদি ওনাকে অসম্মান করে, সেই মানুষটার প্রতি এক অদ্ভুত ঘৃণা জন্ম নেয় মনে। অথচ, আমি বাবার মতো হতে পারিনি। কেউ আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে আমি তাঁকে বাবার মতো ক্ষমা করতে পারি না। মানুষ বদলায়, সময়ের সঙ্গে বদলাতে হয়। কিন্তু আমার বাবা বদলাননি। তিনি যেন জন্ম থেকেই এমন— ক্ষমাশীল, সহনশীল আর নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষ।
বাবা, প্রতিটি দিনই তোমার। তুমি কখনো বুঝতে দাওনি যে কোনো কিছুর অভাব ছিল আমাদের। তুমি নিজের মতো করে ভালোবেসেছ, সামর্থ্যের চেয়েও বেশি দিয়ে গেছ আমাদের। প্রতিদিনই তোমাকে ভালোবাসি, প্রতিদিনই কৃতজ্ঞ থাকি তোমার জন্য। কিন্তু সে ভালোবাসা সব সময় বলা হয়ে ওঠে না। আজ বাবা দিবসে সেই না বলা ভালোবাসাটুকুই জানিয়ে দিই—বাবা, তুমি আমার প্রতিদিনের ভালোবাসা।