১৭ এপ্রিল ২০২৫। পরীক্ষার ধকল শেষে বিকেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। তীব্র যানজট আর ক্লান্তির পরও থামার উপায় ছিল না। খানিক বিশ্রামের ফাঁকেই মনে হলো, ব্যাগ গোছাতে হবে, শেষ মেট্রো ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। দ্রুত হাতে কিছু শার্ট আর টি-শার্ট ভাঁজ না করেই ব্যাগে ভরে বেরিয়ে পড়লাম মেট্রোস্টেশনের পথে।
আমাদের গন্তব্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আয়োজনে আনন্দভ্রমণ। মেট্রোস্টেশনেই প্রথম সঙ্গী হলেন তপন ভাই। মতিঝিলে নেমে রিজেন ভাই ও তাঁর বন্ধু মিলে চারজন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে। পথে পথে আরও যোগ দিলেন বাঁধন, নুসরাত, রিয়াদ, মিজানুর ভাই এবং আমাদের দলের সিনিয়র লাইজু আপু।
রাত ১১টা ১৫-তে ছাড়ার কথা থাকলেও তূর্ণা এক্সপ্রেস ছাড়ল প্রায় ১১টা ৪০-এ। ঢাকা ছাড়ার আগেই ক্যালেন্ডারে তারিখ বদলে গেল। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে যুক্ত হলেন রাইহান ভাই আর ইমরান মাহমুদ ভাই। ভৈরব বাজারে থেমে ফারিয়া আপু আর সাদিয়া আপু দলে যোগ দেন। এখন আমাদের দল ১৪ জনের।
লাইজু আপুর খালি গলায় গান, আড্ডা আর হালকা নাশতা করে রাত এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুমানো গেল না; মোবাইলের চার্জ আর ইন্টারনেটের ধীরগতির কারণে নিজের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছিলাম।
নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছুটা দেরিতে ট্রেন পৌঁছাল চট্টগ্রাম স্টেশনে। সকাল ছয়টার পর পৌঁছে স্টেশনের বাইরে সকালের শুরুটা দেখছিলাম।
নাশতা করতে রওনা দিলাম কাছের একটি রেস্তোরাঁয়। খাবার টেবিলে যোগ দিলেন সিলেট থেকে আসা জাবেদ ভাই আর নুহাশ ভাই। এরপর টাইগারপাসে গিয়ে চট্টগ্রাম শহরের আরও সদস্যদের সঙ্গে পরিচয়—নতুন বন্ধুত্বের হাতছানি।
টানা জার্নির ক্লান্তি ভুলে আমরা আবার চললাম সীতাকুণ্ডের পথে। বাসের মধ্যে গান, আড্ডা, হাসি-মজা চলছেই। বাস থামল অজানা এক পাহাড়ের পাদদেশে।
এরপর চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আমাদের অভিযান শুরু। প্রথমবারের মতো পাহাড় ট্রেকিং আমার জন্য, যদিও দলের কেউ কেউ এর আগে অভিজ্ঞ। হাঁটা, দৌড়, গল্প, ফটোশুট আর বিরতির ফাঁকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে এগোচ্ছিলাম। কোথাও ঝিরঝির বৃষ্টি, কোথাও মৃদু বাতাস... ক্লান্তির মধ্যেও প্রকৃতির প্রশান্তি।
অবশেষে চন্দ্রনাথ চূড়ায় পৌঁছে মনে হলো—হ্যাঁ, আমরাও পারি! চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেন ছবির মতো। দূরে দেখা যাচ্ছিল সাগর, মেঘ আর পাহাড়ের মিশেল।
পাহাড়ে চড়ার আনন্দ শেষে নামার পালা। খাড়া সিঁড়িপথ পেরিয়ে নামার সময় একটু চ্যালেঞ্জই ছিল। মাঝপথে তরমুজ, আনারস আর পেয়ারা খেয়ে একটু তরতাজা হয়ে নেমে এলাম। তবে ফাতেমাতুজ জোহুরা আপু আর কাজী মালিহা আপুর সামান্য পড়ে যাওয়া আমাদের একটু শঙ্কিত করেছিল, যদিও বড় কিছু হয়নি।
এরপর মধ্যাহ্নভোজ সারতে গেলাম সীতাকুণ্ড বাজারে। খাওয়ার পর গুলিয়াখালী সৈকতের উদ্দেশে রওনা। সিএনজিতে ভাগ হয়ে গিয়ে পৌঁছালাম অপার সৌন্দর্যের গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে।
ঘাসে ভরা মাঠ, ছড়ানো শ্বাসমূল, পাশে গর্জে ওঠা সমুদ্র—প্রকৃতির অনুপম দৃশ্যের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি, ছবি তোলা চলছিল। হঠাৎ ঘন মেঘের পর ঝুম বৃষ্টি। মাঠের এক পাশে ফুটবল খেলা, আরেক পাশে দোলনায় দোল—এক জাদুকরী বিকেল।
বৃষ্টি শেষে ঘরে ফেরার পালা। সমুদ্রের পাড় থেকে ফিরতে কেউ পিচ্ছিল কাদামাটির পথে হেঁটে আর কেউ ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে ফিরছিল। আমিসহ বেশ কয়েকজন ছিলাম নৌকায়। নৌকায় উঠেও উত্তেজনার মুহূর্ত! পিচ্ছিল পথে পায়ে কাদা লেগে, জুতা হাতে নিয়েই এগোতে হলো। কাদা পেরিয়ে পথে উঠতেই এক দোকানে জনপ্রতি ১০ টাকায় ধুয়ে নিলাম কাদামাখা পা।
সমুদ্রে যাওয়ার মতো ভাগ করে সবাই সীতাকুণ্ড বাজারে এসে চট্টগ্রাম শহরে ফেরার জন্য বাসে উঠলাম। বাসে পুরস্কার বিতরণ আর কুইজ প্রতিযোগিতায় ফের আনন্দের মুহূর্ত। অনেকেই পথে পথে নেমে গেলেন। টাইগারপাস এসে আনুষ্ঠানিক আনন্দভ্রমণের সমাপ্তি হয়। কিন্তু ঢাকার যাত্রীদের জন্য তখনো পথ বাকি। রেলস্টেশনে পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে ট্রেনে উঠলাম সবাই।
ফেরার পথে পাহাড় ট্রেকিং, সমুদ্রবিলাস শেষে যেন সবার শরীরে ক্লান্তি নেমে আসে। যার যার আসনে বসেই ঘুমানোর চেষ্টা করল সবাই। তবে জেগে থাকায় রাতভর জার্নিতে একটু উৎকণ্ঠা ছিল আমার মধ্যে। পাশের সিটে অলংকার ছিনতাইয়ের চেষ্টা, কখনো মোবাইল চুরি, এক যাত্রীর জ্ঞান হারানোসহ নানাবিধ ঝামেলা। কিছু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সামলে সবাই নিরাপদেই ফিরলাম।
ভোরে বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যার যার বাসায় ফিরলাম। সারা দিনের ক্লান্তি মেখে দুই-আড়াই ঘণ্টা ঘুম দিয়ে আবার শুরু হলো নতুন দিনের গল্প।