কুতুবদিয়া দ্বীপ কেন বিখ্যাত
কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে থাকা একটি দ্বীপ কুতুবদিয়া। দ্বীপটির আয়তন একসময় ছিল প্রায় ৮৩ দশমিক ৩২ বর্গমাইল। চারদিকে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ, মাঝখানে জনপদ—এই দ্বীপটি বাংলাদেশের প্রকৃতি ও অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বর্ষায় দ্বীপের চারপাশে থই থই পানি দেখে মনে হয়, যেন এটি একটি জলবেষ্টিত হাওরাঞ্চল। আর শীত-গ্রীষ্মে মাঠের পর মাঠজুড়ে দেখা যায় লবণ উৎপাদনের দৃশ্য ও শুঁটকি মাছ শুকানোর কর্মযজ্ঞ।
ঐতিহাসিক পটভূমি ও নামকরণ
ধারণা করা হয়, কুতুবদিয়া দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরের বুকে ১৪শ শতকে জেগে ওঠে এবং ১৫শ শতকে মানুষের পদচারণ শুরু হয়। সেই সময় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা দ্বীপ ও আশপাশের এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করত। এ পরিস্থিতিতে কয়েকজন সুফি-দরবেশ দ্বীপে আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কুতুবউদ্দিন, যিনি এখানকার মানুষদের নিরাপত্তা দিতে ও দ্বীপে ইসলামি চেতনার বিস্তার ঘটান। তাঁর নাম অনুসারেই দ্বীপটির নাম হয় কুতুবদিয়া, যা স্থানীয়ভাবে ‘কুতুব আউলিয়ার দেশ’ নামেও পরিচিত।
বাতিঘরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কুতুবদিয়া সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিল তার ঐতিহাসিক বাতিঘরের জন্য। এটি নির্মিত হয় ১৮৪৬ সালে, ব্রিটিশ স্থপতি নিয়ার বার্মিংহামের তত্ত্বাবধানে। বাতিঘরটি ছিল আটতলাবিশিষ্ট, উচ্চতা প্রায় ১২০ ফুট। এতে কাচখচিত জানালা, চারদিকে রেলিং এবং শীর্ষ কক্ষে শক্তিশালী আলো ছিল, যা প্রায় ১৯ মাইল দূর থেকে দেখা যেত। এটি ছিল তৎকালীন নাবিকদের জন্য দিকনির্দেশক একমাত্র ভরসা।
১৯৫৪ সালে শঙ্খ নদের ভাঙনে বাতিঘরটি ধ্বংস হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালে একটি নতুন বাতিঘর নির্মিত হয়, যা আবার ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে যায়। বর্তমান বাতিঘরটি আধুনিকভাবে নির্মাণ করা হলেও আগের ঐতিহাসিক মর্যাদা ও শৈল্পিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারেনি।
কুতুবদিয়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব
এই দ্বীপটি বাংলাদেশের লবণ উৎপাদনের প্রধান অঞ্চলগুলোর একটি। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ লবণ এখান থেকে উৎপাদিত ও সরবরাহ হয়। পাশাপাশি কুতুবদিয়া বিখ্যাত এর বাণিজ্যিক শুঁটকি মাছ উৎপাদন ও আড়তের জন্য।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হয় এখানেই, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
পরিবেশগত সংকট ও ভবিষ্যৎ
প্রতিবছর বর্ষায় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের কারণে কুতুবদিয়া দ্বীপের আয়তন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অনেক এলাকা ইতিমধ্যে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে। তবে এখনো এই দ্বীপ তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানবিক সংযোগ বহন করে চলেছে।
সরকারের উদ্যোগে কিছু প্রতিরক্ষা বাঁধ ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও দ্বীপটিকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত পরিকল্পনা এবং পর্যটন ও অবকাঠামো উন্নয়ন।
পর্যটনের সম্ভাবনা
সুন্দর সমুদ্রতীর, ঐতিহাসিক বাতিঘরের গল্প, সুফি ঐতিহ্য, শুঁটকিপল্লি আর বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প—সব মিলিয়ে কুতুবদিয়া একটি অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যটন সংস্থার সহযোগিতায় দ্বীপটি হয়ে উঠতে পারে এক অনন্য গন্তব্য।
কুতুবদিয়া শুধু একটি দ্বীপ নয়, এটি একটি ইতিহাস, একটি জীবনযুদ্ধ, এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় লড়াইয়ের এক জীবন্ত প্রতীক। যথাযথ পরিকল্পনা, সংরক্ষণ ও উদ্ভাবনী উন্নয়ন–কৌশলের মাধ্যমে এই দ্বীপকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব—তার অতীত ঐতিহ্য নিয়েই ভবিষ্যতের পথে।
সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ভূ-পর্যবেক্ষণ ও পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, বিবিসি বাংলা, কুতুবদিয়া উপজেলা প্রশাসনের লোকাল রেকর্ড।
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার