কাব্যদৃশ্যের নদীতে গীতের স্রোতে ‘নীল ময়ূরের যৌবন’

‘নীল ময়ুরের যৌবন’ নাটকের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

দৃশ্যকাব্যের মোহনীয় এক নদী। তাতে বয়ে চলেছে গীতের স্রোত। সেই স্রোতে সমান ভাব নিয়ে বহমান বর্ণনা ও সংলাপের ঘনিষ্ঠতা প্রগাঢ় ছান্দসিক।

রঙ্গের আগুন লাগিয়ে দিয়ে বাদ্যের তানে সরল মানুষদের আনন্দোৎসব দ্বারা দৃশ্যপ্রবাহের সূচনা হয়। মধুর মতো কানে বর্ষিত হয়, ‘রঙ্গেরও আগুন লেগেছে রে মনে, রক্তে মাতমে ফাগুয়ার খেলা বনে।’

কোনো এক সামন্ত যুগে এতদ্–অঞ্চলের গল্প নিয়ে নাটকটির কাহিনি। এর আখ্যান এক অথচ বহুমাত্রিক, যেটি প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বের প্রেক্ষাপট, কিন্তু সমকালের প্রেক্ষাপটেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। প্রেম আর দ্রোহের গ্রন্থণে বিস্তারিত হওয়া এই কাহিনির পরতে পরতে অনুভবের তীব্রতা আর জীবনবোধের গভীর প্রকাশ। এতে কল্পনার আশ্রয় আছে, তবে শিল্পসত্য জীবনসত্যকে আড়াল করেনি।

অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ুরের যৌবন’ উপন্যাসটির নাট্যায়ন করেন। নাটকটি উপন্যাস থেকে সৃজিত হলেও এখানে পরিলক্ষিত নাট্যলিপিকার বা নির্দেশকের আপন চোখের দেখা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক অর্ক নাটকটি এ মৌসুমেও এনেছেন মঞ্চে। তাঁরই সংগীতায়োজিত এবং নির্দেশিত নাটকটি প্রদর্শিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনের নাট্যগৃহে। ৪, ৫ ও ৬ডিসেম্বর—তিন দিনে এর পাঁচটি প্রযোজনা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পূর্বের ১০টিসহ মোট ১৫টি প্রদর্শনী হলো।

পাঁচালি তথা আবহমানকাল ধরে চলমান বাংলা অঞ্চলের স্বকীয় রীতি এর অন্যতম পরিবেশনা বৈশিষ্ট্য, যেখানে অভিনেতা চরিত্রসত্তা ছাড়া জীবনব্যাখ্যাকারী সত্তাও। এ সত্তা কাহিনিকে স্পষ্ট ও গতিময় করে আর সহসা উপস্থাপনে বোধে নাড়া দিতে ক্রিয়া করে। নির্দেশকের ভাষ্য, বর্ণনাকে সংলাপময় করার নিরীক্ষাসহ বরাবরের মতো গীতময়তার সর্বপ্লাবী প্রয়োগ এর সমগ্র শরীরে রাখা হয়েছে, যেখানে সত্যের চেয়ে অনুভবের শক্তি উদ্‌যাপনই মুখ্য।

নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র কাহ্নপা ও ডোম্বী। অর্থনৈতিক মুক্তিহীন প্রেমিক কবি কাহ্নপা রাজদরবারে পাখা টানার কাজ করে। উচ্চমার্গীয় চিন্তার অধিকারিণী, সুশ্রী ও বহুগুণে গুণান্বিতা মাঝি ডোম্বী তার প্রেয়সী। বউ শবরীও তার অন্তর্জগতের লোক। পান করতে করতে হাড়িয়া উৎপাদনে দক্ষ স্ত্রীকে কাহ্নপা হৃদয়ের সমস্ত চোখ দিয়ে দেখে, প্রকাশ করে ভালোবাসার গভীরতা। নিবিড় ভালোবাসাবাক্যে শবরীর মনে আরও ‘কাছে রেখে দূর করার’ ভয় জাগে। মহাজাগতিক প্রেম কি আর পৃথিবীর সংকীর্ণ যুক্তি দ্বারা চালিত হতে পারে! ডোম্বী কাহ্নকে বিনাকড়িতে রোজ পারাপার করে। প্রেমাস্পদকে পার করে যেন তার কড়ির অধিক প্রাপ্তি হয়। ডোম্বী জলে তরঙ্গ তুলে নৌকা বাইলেও প্রেমের তরঙ্গ উভয়ের মনেই আন্দোলন করে। কাহ্ন একবার তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে পাড়ে উঠলে ডোম্বীর তীব্র অনুরাগ ব্যক্ত হয়। ‘আবার কবে ফিরবে’ শীর্ষক ডোম্বীর প্রশ্নে ‘সবার মুখে শুধু ফেরার কথা, যদি বলি ফিরব না, ফিরতে আমার ভালো লাগে না..’ প্রত্যুত্তর হলে দর্শকহৃদয়ে করুণ সুর বেজে ওঠে, গীত হয় রবিগুহ মজুমদারের লেখা—‘এ মৌসুমে পরদেশে যেতে তোমায় দেব না।’

বন্ধুরা হরিণ শিকার করলেও সংবেদনশীল কবি শিকার করতে পারে না। হরিণের চোখে দেখে প্রিয়তমার মুখ। কাহ্নদের সমাজ নিম্নশ্রেণির। ব্রাহ্মণদের কাছে তাদের বিন্দুমাত্র গুরুত্বও নেই। তাদের ফলন, উৎপাদন বা প্রাপ্য বস্তু যায় রাজা বা মন্ত্রীর গুদামে।

এই নাটকের প্রতিটি প্রযোজনা দর্শকদের মোহাবিষ্ট করেছে, অনেকের ঝরিয়েছে অশ্রু
ছবি: সংগৃহীত

কবি কাহ্নপা তার বা তাদের আপন ভাষায় গীত রচনা করে। সেই গীত রাজদরবারে পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু মন্ত্রী দেবল ভদ্র ও রাজলোকরা সে ভাষাকে ম্লেচ্ছ বলে অভিহিত করে, ত্রুটি রাখে না ব্যঙ্গ বা তামাসারও। তাদের কাছে সংস্কৃত ভাষায় শুধু পরিশুদ্ধ ও ঈশ্বরের ভাষা। আর নিচু জাতের ডোম্বীদের দিকে দৃষ্টিপাত হলেও যাদের জাত যায়। তবে এমন আইনও প্রণীত হয় যে ব্রাহ্মণরা নিম্নবর্গের যেকোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে মেলামেশা (জোরপূর্বক) করতে পারবে। এমতালোকে কবি কুক্কুরিপা রচনা করে, ‘দুলি দুলি পিঠা ধরণ ন জাই, রুখের তেন্তোলি কুম্ভিরে খাঅ।’

উল্লেখ্য, কোমল, স্নিগ্ধ ডোম্বীর মনে কেবল প্রেম নয়, আছে দ্রোহও। রাতে বলাইশর্মা অনৈতিক ভোগে এলে ডোম্বী তার বুকে করে আকস্মিক ছুরিকাঘাত। ব্রাহ্মণ্যবাদের আগ্রাসনকে ঘৃণা করতে করতেই এই সাহসের সঞ্চয়। আর বলা সমীচীন, প্রেমের দোলাচালে খুনসুটিও কম নয়। ডোম্বীর রূপ বা গুণ বর্ণনা করলে সে ততধিক খুশি হয় কিনা বলা মুশকিল, তবে উচ্চারণ করতে শোনা যায়, ‘কবি মানেই অপরেরটা লুকিয়ে দেখার অভ্যাস।’

এদিকে রাজদরবারে গীত পড়ার বহুল প্রতীক্ষিত ক্ষণটি কাহ্নর আসে, কিন্তু পড়ার সুযোগ আসে না। বরং আসে কবিকে অপমান আর অপদস্ত করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার মতো নির্মম মুহূর্ত। ডোম্বী এই খবর শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। অপমান ও জুলুমের প্রতিশোধ না নেওয়ায় প্রেমিকের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। যেকোনোভাবে অন্যায়ের প্রতিশোধ এবং ভাষার সম্মান অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে।

এতে পরিণয়ে প্রেমের মতো সত্য ভাস্বর হলেও কর্তন করা হয় কাহ্নপার দুই হাত আর ডোম্বীকে ঝোলানো হয় ফাঁসিতে।

চর্যাপদ থেকে তো বটেই রবিগৃহ মজুমদার, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কঙ্কন ভট্টাচার্য, আল মাহমুদ, প্রতুল মুখোপাধ্যায়সহ সমকালীন গীতিকার শুভাশিস সিনহা ও অর্ণব মল্লিকের সংগীতের গাঁথুনিতে অগ্রগামী নাটকটি চিত্তে দেয় দোলা, আবেগে করে কম্পন আর বোধে ফেলে আলো। এর অন্যতম কারণ, প্রতিটি গীতের গায়কিতে বিদ্যমান বিশেষ শৈলী, যাতে লুকায়িত হলেও উপস্থিত বা বর্তমান প্রাণবন্ত অভিনয়।

নাটকটিতে কাহ্নপা চরিত্রে সাজ্জাদুল শুভ, ডোম্বী চরিত্রে তাসফিয়া জান্নাত বাঁধন, শবরী চরিত্রে আঞ্জুমা মিম, দেবল ভদ্র চরিত্রে ফাহিম মালিক ইভানসহ (শিক্ষক) মোট ৩৫ জন কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৮তম আবর্তনের শিক্ষার্থী ছাড়াও ৫৪তম পর্যন্ত বিভিন্ন আবর্তনের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন।

একক গানে ছিলেন প্রজয় বকশী, ইগিমি চাকমা ও জয়ন্ত ত্রিপুরাসহ অন্যরা। শুভর অভিনয়ে মঞ্চে যেন প্রতিবার চর্যাপদের কাহ্নপাদেরই আবির্ভাব হয়েছিল। আর দেহাবয়বে সুন্দরের আদর্শ বিকাশযুক্ত বাঁধন তাঁর সুর, কথা আর ক্রিয়ায় হয়ে উঠেছিল যেন কোনো কবি-কল্পনার সফেদ, স্নিগ্ধ ও প্রসন্নময়ী এক ধ্রূপদি সুন্দর নায়িকা ও মঞ্চের নিখুঁত অভিনেত্রী। দৃশ্যকাব্যে নেপথ্যের অভিনয়শিল্পীরা পাখির কলকাকলি, মোরগের ডাক, ঝিঁঝির আওয়াজসহ কণ্ঠের জাদুতে প্রয়োজন মোতাবেক সৃষ্টি করেছিলেন কখনো ভোরের আবহ, কখনো আবার রাতের নির্জনতা। বলা সমীচীন, নাটকটির যে বিশেষ নৌকা, তা দর্শককে আরেক মাত্রায় ভাবার সুযোগ দেয়।

অভিনেতাদের মানানসই পোশাকের সঙ্গে গাছের শিকড় দিয়ে বাহু ও গোড়ালি বন্ধনী প্রাচীন যুগটিকে স্পষ্ট করেছে। পোশাকের সামঞ্জস্যতা, আলোর নিপুণ প্রক্ষেপণ, বাঁশঝাড় তৈরি করে পল্লির আবহ নির্মাণ, নৌকার চলাচলসহ মঞ্চোপকরণ ও সজ্জায় পরিমিতি এবং অভিনয়ক্রিয়ার সুষম বিকাশ নাটকটিকে ঋদ্ধ করেছেন। রঙ্গেরও আগুন লেগেছে মনে থেকে ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’ পর্যন্ত গীতল এই নাটকের প্রতিটি প্রযোজনা দর্শকদের মোহাবিষ্ট করেছে, অনেকের ঝরিয়েছে অশ্রু।

শিক্ষার্থী, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়