ভার্চ্যুয়াল মানুষ, ভার্চ্যুয়াল জীবন
একটা সময় বোধ আসে, তাঁরা আসলে দেয়ালের ওপাশে কাচের ঘরে আটকে থাকা প্রতিচ্ছবি। ভার্চ্যুয়াল–জগতের মানুষ।
মানুষ একা থাকতে পারে না। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সে চায় আরেকজনের সঙ্গে জড়িয়ে–পেঁচিয়ে থাকতে, কারও সঙ্গে দুটি সুখ–দুঃখের কথা বলতে, মনের কার্নিশে উঁকি দেওয়া ভাবনাগুলো ভাগ করতে, একটু ভালোবাসার পরশ পেতে। কখনো মনের নীল আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে কাউকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে, একটু সান্ত্বনা পেতে।
আগে এই চাহিদাগুলো পূরণ হতো পরিবারে, বন্ধুদের আড্ডায় ও প্রতিবেশীর উঠানে। এখন সময় বদলে গেছে। আধুনিকতা ও ভার্চ্যুয়ালের আবরণে মোড়ানো এক দৈত্য এসে গ্রাস করে নিয়েছে সব। মানুষ এখন আশ্রয় খুঁজে নেয় ভার্চ্যুয়াল–জগতের স্ক্রিনে, সুখ–দুঃখের গল্প লেখে, ভাব বিনিময় করে, ভালোবাসা হাতড়ে বেড়ায় সবুজ বাতির মিছিলে।
এ জগতের চারপাশে সবাই আছে অথচ কোথাও যেন কেউ নেই। এই ভার্চ্যুয়াল জীবনে আমরা যেন এক অদ্ভুত মোহের জালে আটকা পড়েছি। অবিরত কথার বৃষ্টি নামাই ডিজিটাল স্ক্রিনের ওপারে থাকা মানুষের সঙ্গে। কিন্তু তাঁদের অবয়ব ছুঁতে পারি না, টের পাই না প্রকৃত উপস্থিতি। কখনো চারপাশটা একাকিত্বের চাদরে ঢেকে গেলে কাউকে পাশে পাই না হাতটা ধরার জন্য, ভরসা দেওয়ার জন্য। বুকফাটা কান্না এলেও কাঁধে মাথা রাখার মতো একজন মানুষ খুঁজে পাই না। এটাই আমাদের আধুনিক ভার্চ্যুয়াল জীবনের করুণ বাস্তবতা।
ভার্চ্যুয়াল–দুনিয়ার ক্যানভাসজুড়ে নানা রঙের ছড়াছড়ি। এই রঙিন দুনিয়ার মানুষ মিষ্টি করে কথা বলে, ইমোজি দিয়ে ভালোবাসা জানায়। এখানে এক ক্লিকেই বন্ধুত্ব, এক ক্লিকেই বিচ্ছেদ। শুনেছি, যা গড়তে যতটা সময় লাগে, তা ভাঙতেও নাকি ঠিক ততটা সময় লাগে। এখানে সহজেই সব হয়, আবার সহজেই ভেঙে তছনছ হয়ে যায়।
প্রথম দিকে মনে হয়, এই ভার্চ্যুয়াল–জগতের মানুষ বুঝি অনেক কাছের, অনেক আপন। দিনরাত কথার পিঠে কথা হয়, হাসি–কান্না ভাগ হয়, গল্প জমে জমে উপন্যাস হয়। তবে একটা সময় বোধ আসে, তাঁরা আসলে দেয়ালের ওপাশে কাচের ঘরে আটকে থাকা প্রতিচ্ছবি। ভার্চ্যুয়াল–জগতের মানুষ। এই জগৎ এক পাশে যতই আলোঝলমলে হোক না কেন, অপর পাশে নিকষ আঁধার আর ঘোলাটে অন্ধকার।
এই ভার্চ্যুয়াল–দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো হারাচ্ছি। সেই বন্ধু, যে দুপুরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ডাকত খেলতে যাওয়ার জন্য, তার জায়গা দখল নিচ্ছে এক অচেনা প্রোফাইল, যার আসল পরিচয় হয়তো আমরা জানিও না। আমরা হারাচ্ছি মা–বাবার সঙ্গে বিকেলের গল্প, ছোট ভাইবোনের খুনসুটি ও চায়ের দোকানে নির্ভেজাল আড্ডা।
তবে বলছি না ভার্চ্যুয়াল জীবন পুরোপুরি খারাপ। প্রযুক্তি আমাদের উপকার করছে, আমাদের অনেক সুবিধা দিয়েছে। দূরে থাকা প্রিয় মানুষকে কাছে এনেছে, জ্ঞান আর যোগাযোগের পথ খুলে দিয়েছে। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জীবন যদি আমাদের একমাত্র জীবন হয়ে যায়, তখন সেটা বিপদ। আমাদের এটা মাথায় রাখা জরুরি, ভার্চ্যুয়াল মানুষ জীবনের সাময়িক আনন্দ হতে পারে, কিন্তু ভরসা হতে পারে না।
আমরা কী চাচ্ছি, সেটা আমাদের ঠিক করতে হবে। জীবন খুব সংক্ষিপ্ত। সময় চলে যাচ্ছে হাতের আঙুলের ছোঁয়ায়। আমরা হাসি শেয়ার করি অথচ সেই হাসির মানুষটাই পাশে থাকে না। আমরা ভালোবাসি অথচ মানুষটাকে কাছে পাই না। এই যে দূরত্ব, এটাই ভার্চ্যুয়াল জীবনের সীমাবদ্ধতা।
ভার্চ্যুয়াল জীবন বাস্তবের বিকল্প হতে পারে না। এটা একটা সহায়ক, দরজামাত্র, কিন্তু ঘর নয়। আসল সম্পর্ক তৈরি হয় কাঁধে হাত রেখে, কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে। তাই এখন সময় একটু থামার।
চলুন, আমরা স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়ে এবার পাশে থাকা মানুষটার দিকে একটু তাকাই। ভার্চ্যুয়াল–দুনিয়ায় হারিয়ে না গিয়ে বাস্তব জীবনের স্পর্শ খুঁজি। কারণ, দিন শেষে বাস্তব জীবনই জীবন, বাকিটা শুধু প্রতিচ্ছবি।