যিনি নাট্যমঞ্চে আলো ছড়িয়ে যান যুগ থেকে যুগান্তরে

নিজের নাট্য প্রযোজনার ফেস্টুনের পাশে সেলিম আল দীনছবি: সংগৃহীত
সেলিম আল দীন ছিলেন প্রথাবিরোধী নাট্যকার। যখন অধিকাংশ নাট্যকর্মী পাশ্চাত্য রীতিকে অনুসরণ করছিলেন, তখন তিনি খুঁজছিলেন বাংলার নিজস্ব নাট্যধারার শিকড়।

বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন এক অবিস্মরণীয় নাম। তিনি সংস্কৃতি ভাবনার এক মহামহিম সাধক। নাট্যকলাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন তার আদি রূপে এক সমবেত উৎসবের শিল্পে। যেখানে মিলেমিশে একাকার দর্শক, অভিনেতা ও কাহিনি।

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট, ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার সবুজ শস্যের আঁচলে জড়ানো সেনেরখিল গ্রামে। পিতা মফিজউদ্দিন আহমেদ ও মাতা ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান সেলিম আল দীনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানে। শৈশবের গ্রামীণ আকাশ, ধানের মাঠ, ভাটিয়ালি আর পালাগানের সুর তাঁকে অদৃশ্য ডোরে টেনে নেয় লোকজ জীবন ও কাহিনির গভীরে। মাটির ঘ্রাণ, মানুষের গল্প, পল্লিগানের সুর তাঁর অন্তরে বুনেছিল এক অমলিন আকর্ষণ। সেই আকর্ষণই পরবর্তী সময়ে তাঁকে দাঁড় করায় বাংলা নাটকের এক অনন্য ভুবনে, যেখানে গ্রাম, গান আর লোকজ আখ্যান মিলেমিশে গড়ে তোলে মহাকাব্যিক নাট্যজগৎ।

সেলিম আল দীন ছিলেন প্রথাবিরোধী নাট্যকার। যখন অধিকাংশ নাট্যকর্মী পাশ্চাত্য রীতিকে অনুসরণ করছিলেন, তখন তিনি খুঁজছিলেন বাংলার নিজস্ব নাট্যধারার শিকড়। সেলিম আল দীন বিশ্বাস করতেন, ‘নাটক কেবল বিনোদনের জন্য নয়, এটি মানুষের সম্মিলিত জীবনযাপন ও আচার-অনুষ্ঠানের সম্প্রসারিত রূপ।’ তাই তাঁর নাটকে ফুটে উঠেছে গ্রামীণ জীবনের আখ্যান, লোকগাথা, পালা, বাউলগান, ভাটিয়ালি, কীর্তন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে শুরু করে লোকবিশ্বাসের নানা রূপ। তিনি বাংলা নাটককে দিয়েছেন এক নাট্যব্যাকরণ, যা নন্দনশীল, দার্শনিক এবং লোকজ গন্ধে ভরপুর।

সেলিম আল দীনের সৃষ্ট নাটকগুলোই প্রমাণ করে এই ভিন্নতা। ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘জন্ডিস ও বিবিধ বর্ণনা’, ‘হাত হদাই’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘চাকা’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’—প্রতিটি নাটকেই মাটি ও মানুষের বর্ণনা যেমন প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তেমনি এসেছে অনন্তকালীন জীবনতত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা। বিশেষ করে ‘কিত্তনখোলা’ ও ‘চাকা’—এই দুই নাটক বাংলা মঞ্চে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করে। দর্শক বুঝতে শিখেছে, নাটক কেবল গল্প বলার জন্য নয়, এটি মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব, বেদনা ও আনন্দের বহুমাত্রিক প্রতিফলন।

সেলিম আল দীন। সংগৃহীত

সেলিম আল দীনের লেখার ভাষা ছিল একেবারেই নিজস্ব। সংলাপের ভেতরে ছিল ছন্দ, সুর, আর কাব্যের আবেদন। মনে হয় যেন গদ্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অদৃশ্য গান। সেলিম আল দীনের নাটক পড়লে বা মঞ্চে দেখলে দর্শক যেমন দার্শনিক তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়, তেমনি ছুঁয়ে যায় গ্রামীণ আচার, মাঠ-ঘাট, নদী ও মানুষের হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহের চিরন্তন সুর। নাট্যভাষার এই অনন্য কাব্যিক সৌন্দর্য তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নাট্যজগতের মহারথী হিসেবে।

গুণী নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নাট্যশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। অসংখ্য তরুণ নাট্যকর্মী ও শিক্ষার্থী তাঁর হাতে তৈরি হয়ে আজও নাট্যচর্চায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গুরু, পরামর্শদাতা। ছাত্রদের শিখিয়েছেন কেবল নাট্যশিল্প নয়, শিখিয়েছেন জীবনবোধ।

সেলিম আল দীনের অবদান স্বীকৃত হয়েছে নানা পুরস্কার ও সম্মানে। তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক। তবু তাঁর প্রকৃত প্রাপ্তি কেবল এই পদক বা সম্মানেই সীমাবদ্ধ নয়। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো দর্শকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং সহকর্মীদের অফুরন্ত শ্রদ্ধা। সময়ের পর সময়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যখনই তাঁর নাটক মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠে, তখনই যেন নতুনভাবে তাঁকে আবিষ্কার করা যায় এক অনন্ত নক্ষত্রের মতো। যিনি নাট্যমঞ্চে আলো ছড়িয়ে যান যুগ থেকে যুগান্তরে।

২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। কিন্তু তাঁর প্রস্থান যেন কেবল শারীরিক। তাঁর নাটক, তাঁর দর্শন, তাঁর জীবনতত্ত্ব আজও বেঁচে আছে। প্রতিটি নাট্যদল, প্রত্যেক নতুন দর্শক, প্রতিটি মঞ্চায়ন তাঁর সৃষ্টিকে আবারও নতুন করে জীবিত করে তোলে। তিনি নাট্যলোকের সেই মহাযাত্রী, যিনি নাটককে করেছিলেন সময়, সমাজ ও সভ্যতার আয়না।

বন্ধু, গাজীপুর বন্ধুসভা