নৃত্যে জলবায়ু সংকটের গল্প ‘নীল আকাশ’ ও আনন্দিতার শিল্পযাত্রা

গবেষণাধর্মী নৃত্য পরিবেশনা ‘নীল আকাশ’, একজন মেয়ের গল্পকে ঘিরে
ছবি: হেইলি সালটার

গবেষণাধর্মী নৃত্য পরিবেশনা ‘নীল আকাশ’, একজন মেয়ের গল্পকে ঘিরে। সুবর্ণা! যার স্বপ্ন সে পড়ালেখা করবে, অনেক বড় কিছু হবে। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের ছোট্ট গ্রাম বাহাদুরপুরে তার বেড়ে ওঠা। হাওরের বন্যার সঙ্গে তার ও পরিবারের সংগ্রাম নিয়ে নৃত্যের গল্পটি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে যে প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, সেটাই মুখ্য বিষয় গল্পটির। সবার মধ্যে একটা প্রশ্ন জাগানো, কীভাবে আমরা পৃথিবীকে আগামীর জন্য সুস্থ রাখতে পারি।

নৃত্যটি পরিবেশনা করেছেন বাংলাদেশের নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার আনন্দিতা খান। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের মিডল্যান্ডস আর্টস সেন্টারে নৃত্যটি মঞ্চস্থ হয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি ও শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যের সংগঠন সাম্পাদ আর্টস এবং আনন্দিতা খানের যৌথ পরিকল্পনা। অনুদান দিচ্ছে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘কানেকশনস থ্রু কালচার’ গ্র্যান্ট।

ছবি: হেইলি সালটার

পরিবেশনাটির প্রধান নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিন সপ্তাহ ধরে বার্মিংহামে কাজ করেছেন আনন্দিতা খান। গবেষণার কাজে মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন আলোকচিত্রী আসিফ মোসাদ্দেক। পুরো সাম্পাদ টিম স্টুডিওতে প্রজেক্টটির ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করে। পরিবেশনার নেপথ্যে ছিলেন সাম্পাদের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর পিয়ালি রায়। নাট্যবিন্যাসের নির্দেশক হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিচালক ভাবিক পারমার, স্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট নিয়ে লার্নিং ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট ম্যানেজার জিলিয়ান টুয়েইট এবং পুরো কাজটির সমন্বয় করেন সাম্পাদের প্রকল্প ও কর্মসূচি ব্যবস্থাপক জেমস ভেগনুটি। সংগীতে ছিলেন মেনদি মহিন্দর সিংহ ও আদি রায়। গল্পকারের ভূমিকায় ছিলেন রোচি রামপাল। পরিবেশনাটিতে স্থানীয় শিল্পীরাও কাজ করেন।

যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে সুনামগঞ্জে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করেছেন আনন্দিতা খান ও আসিফ মোসাদ্দেক। ২০২৪ সালে বন্যা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে তাঁরা সেখানে পৌঁছান। এই কাজে সহযোগিতা করেন স্থানীয় নৃত্যশিল্পী সৌরভ অধিকারী ও তাঁর ছাত্র সাগর। এক সপ্তাহের ফিল্ড ভিজিটে প্রথমে যান বাহাদুরপুর গ্রামে। সুনামগঞ্জ শহর থেকে বেশ দূরে গ্রামটি। বিশ্বম্ভরপুর ইউনিয়ন থেকে নৌকা একমাত্র উপায় সেখানে যাওয়ার। পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের গল্প শোনা ও সংস্কৃতি বোঝা। হাওর এলাকার মানুষ কীভাবে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে থেকে কীভাবে জীবন যাপন করছেন, তা অনুধাবন করা। ‘নীল আকাশ’ প্রজেক্টটির গল্পের সূত্রপাত এই বাহাদুরপুর গ্রাম থেকেই। পরে তাহিরপুরে যান তাঁরা।

যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে সুনামগঞ্জে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করেন আনন্দিতা খান
ছবি: আসিফ মোসাদ্দেক

এ বিষয়ে আনন্দিতা খান বলেন, কাজটি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য—এ দুই দেশের ওপর প্রকৃতির যে প্রভাব তা নিয়ে নির্মিত। বাংলাদেশের মধ্যে সুনামগঞ্জ বেছে নেওয়ার কারণ হলো, এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং হাওরের পরিবেশের বর্তমান অবস্থা।
পুরো গবেষণাকাজটির ওপর ভিডিও তথ্যচিত্র তৈরি করেন আসিফ মোসাদ্দেক। তথ্যচিত্রটি বার্মিংহামে ফাইনাল প্রেজেন্টেশনে দেখানো হয়েছে।

এরই মধ্যে প্রকল্পটির প্রথম ধাপ ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শেষ হয়েছে। এক বছরের মধ্যে এটাকে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রোডাকশনে পরিণত করা হবে। এরপর গবেষণাটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে প্রদর্শন করে বাচ্চাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলেও এ বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ কর্মশালা করানো হবে। পুরো কাজটি পরিচালনা করবে সাম্পাদ ও আনন্দিতা খান মিলে।

প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া বিষয়ে আনন্দিতা খান বলেন, ‘সাম্পাদ আর্টসের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর পিয়ালি রায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ড্যান্স অ্যালায়েন্স সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। সাম্পাদ ২০২৪ সালে আমাকে এই কাজের প্রস্তাব দেয়, যা আমার জন্য অনেক বড় একটি সুযোগ। পরবর্তী সময়ে আমরা যৌথভাবে অনুদানের জন্য কাজ করি।’

নৃত্য নিয়ে পথচলাতেই আনন্দ আনন্দিতা খানের
ছবি: আসিফ মোসাদ্দেক

শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিষয়ে বিবিএ ও এমবিএ করেছেন আনন্দিতা খান। যুক্ত আছেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গেও। ঢাকা মহানগর বন্ধুসভায় পরিবেশ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে নৃত্য নিয়ে পথচলাতেই তাঁর যত আনন্দ। স্বপ্ন দেখেন মানবতাকে প্রশ্ন করে, গভীর রাজনৈতিক বার্তা বহন করে—এমন বিষয়গুলো নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে কাজ করে যাওয়ার। আনন্দিতা খান বলেন, ‘নৃত্য এখন আমার জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। যে কথাগুলো প্রকাশ করতে পারি না, সেগুলো নৃত্যের মাধ্যমে মঞ্চে নিয়ে আসি। কয়েক বছর ধরে সমসাময়িক বিষয়ে নৃত্য নিয়ে কাজ করছি। এমন সব বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করছি, যা মানবতাকে প্রশ্ন করে, গভীর রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। আমার স্বপ্ন, এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে যাওয়া।’

আনন্দিতা খানের নৃত্যাঙ্গনে আসাটা বেশ নাটকীয়। বাবা ইসহাক খান একজন লেখক, নাট্যকার। ২০০৩-০৪ সালের দিকে তাঁরই ধারাবাহিক নাটক ‘খোলা দুয়ারে’ কাজ করেছিলেন শিশুশিল্পী হিসেবে। আরজুমান্দ আরা বকুল ছিলেন মা চরিত্রে, ফজলুর রহমান বাবু ছিলেন বাবা চরিত্রে। সেই ঘটনা স্মরণ করে এই নৃত্যশিল্পী বলেন, ‘কয়েকটা শট দেখে নাটকটির পরিচালক আমার আম্মুকে বলেন আমাকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিতে। তাহলে আমার এক্সপ্রেশন বেশ ফুটে আসবে। এরপর সুলতানা হায়দারের কাছে নৃত্যের তালিম শুরু। পরে বহু গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছি। ২০১৩ থেকে সাধনার সঙ্গে পথচলা শুরু। নাটকে আর ফেরা হয়নি, আমার ধ্যান সব নৃত্যকে ঘিরেই থেকে যায়। আমার জীবনসঙ্গীও একসময় নৃত্য করতেন। এখন দুই পরিবার থেকেই অনেক বেশি সহযোগিতা পাই নৃত্যকে ধারণ করে রাখার জন্য।’

আনন্দিতা খান স্বপ্ন দেখেন মানবতাকে প্রশ্ন করে, গভীর রাজনৈতিক বার্তা বহন করে—এমন বিষয়গুলো নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে কাজ করে যাওয়ার
ছবি: হেইলি সালটার

২০১৮ সালে প্রথম ইয়াং কোরিওগ্রাফার হিসেবে গ্যোথে ইনস্টিটিউটের ‘ইয়াং কোরিওগ্রাফারস প্ল্যাটফর্ম’-এ মৌলিক কাজ তৈরির জন্য নির্বাচিত হন আনন্দিতা খান। সেখানে তাঁর প্রথম সমসাময়িক কাজ ‘রিফিউজি’ নির্মিত হয়। ২০১৯ সালে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ওশান ড্যান্স ফেস্টিভ্যালে নৃত্য পরিবেশনার পাশাপাশি আয়োজক হিসেবেও যুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালে আকরাম খান কোম্পানির অনলাইন প্রজেক্ট ‘অ্যানিমেল কিংডম’-এ যুক্ত হন। এখন পর্যন্ত পাঁচটি আন্তর্জাতিক রেসিডেন্সি করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সেগুলো হলো—আড্ডা (২০২১), গ্যোথে ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের অনলাইন রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম; গ্যোথে ইনস্টিটিউট নিউ দিল্লি ও গ্যোথে ইনস্টিটিউট ইন্দোনেশিয়ার আয়োজনে ইনভিজিবল ড্যান্স (২০২৩), আহমেদাবাদ, ভারত; ইন্টারন্যাশনাল ইয়াং কোরিওগ্রাফারস প্রজেক্ট (২০২৪), তাইওয়ান; ব্রেমেন থিয়েটারে ইন্টার্নশিপ (২০২৪), জার্মানি; নীল আকাশ (২০২৫), যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশে সাধনার আয়োজনে মুনসুন রেসিডেন্সিতে অংশ নেন ২০২৩ সালে। রেসিডেন্সি ছাড়া আনন্দিতা খান সমসাময়িক নৃত্যালেখ্যও তৈরি করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো ‘উদ্বাস্তু’, ‘ক্রাইসিস’, ‘ইনোসেন্ট লস্ট’, ‘হারমোনি অব লাইফ’। এর মধ্যে ‘হারমোনি অব লাইফ’ ওয়ার্ল্ড ড্যান্স অ্যালায়েন্সের বিগিন অ্যাগেইন গ্র্যান্ট থেকে তৈরি। এটি হংকংয়ের সুইট ফেস্টিভ্যাল এবং আমেরিকার শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়।