অপরূপ সৌন্দর্যঘেরা সিলেট: এক স্মৃতিমাখা ভ্রমণ

ধলাই নদের সৌন্দর্য, সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর যাওয়ার পথেছবি: লেখক

অনেক দিনের লালিত ইচ্ছা ছিল সিলেট যাওয়ার। কিন্তু জীবনের ব্যস্ততা যেন বারবার আঁকড়ে ধরেছে পায়ের শিকল। এবার ঈদের ছুটিতে স্ত্রীকে বললাম, ‘চলো, স্বপ্ন ছুঁয়ে আসি!’

ফেনী থেকে সিলেট যাওয়ার জন্য ট্রেনই সবচেয়ে সহজপথ। শুরু হলো টিকিট সংগ্রহের যুদ্ধ। ৩১ মে ফেনী রেলস্টেশনে গিয়ে শুনি, টিকিট কেবল অনলাইনে, ১ থেকে ২২ জুনের টিকিট আছে কেবল। দিনভর চেষ্টা করি, ফিরে আসি শূন্য হাতে। চেনা-অচেনা সবার সঙ্গে যোগাযোগ। কেউই দিতে পারেন না আশার আলো। পরে যোগাযোগ করি কাছের এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। সে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে এক কারবারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

লোকটিকে বলি, ১০ তারিখ সকালে পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের টিকিট লাগবে। তিনি জানালেন, দিতে পারবেন। স্নিগ্ধা দুটি সিটের টিকিটের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা করে মোট ২ হাজার ৪০০ টাকা লাগবে! আমিও রাজি হয়ে যাই। কিন্তু ৯ তারিখ দুপুর পর্যন্ত টিকিটের কোনো খোঁজ নেই। আমরাও আশা ছেড়ে দিই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, কক্সবাজার যাব। এর মধ্যেই রাত ১০টায় লোকটি জানালেন, টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছে। কেবিনের সিট। তাঁকে অতিরিক্ত আরও ৬০০ টাকা দিতে হবে। রাতেই টিকিট সংগ্রহ করে ফেলি।

পরদিন সকাল ৯টা ১৪ মিনিটে ট্রেন আসে। নির্দিষ্ট কেবিনে আমরা উঠে বসি। মুহূর্ত পরই আরও একজন যাত্রী ওঠেন আমাদের সঙ্গে। এই লোক ১ হাজার ৭০০ টাকায় টিকিট কিনেছেন। যাহোক, ট্রেন ভ্রমণে নতুন এক অভিজ্ঞতা। কেবিনে কোনো ফেরিওয়ালা, তৃতীয় লিঙ্গ, টিকিট মাস্টার—এসবের কোনো ঝামেলা নেই। আমাদের সঙ্গে যে ভদ্রলোক ছিলেন, উনি অত্যন্ত ভালো মানুষ।

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছুটে চলে সবুজে মোড়া গ্রাম, নদী, চা-বাগানের মধ্য দিয়ে। প্রকৃতির রঙিন তুলিতে আঁকা দৃশ্যপট যেন কবিতার মতো হৃদয়ে বাজে। সন্ধ্যায় পৌঁছাই সিলেট স্টেশন। সেখান থেকে উপশহরে দাদুর বাড়ি যাই।

পরদিনের পরিকল্পনা করি বড় কাকার সঙ্গে বসে। গন্তব্য রাতারগুল ও ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। সকালে রিকশায় আম্বরখানা। সেখান থেকে সিএনজিতে আঁকাবাঁকা পথে রাতারগুলের দিকে যাত্রা। চারপাশে চা-বাগান, রোদে ঝলমল সবুজ পাতা। সিএনজিচালক সেলুর গল্পে ধরা পড়ে জীবনের কঠোর বাস্তবতা। তাঁর পাঁচ ছেলে–মেয়ে। এক মেয়ে পড়ে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেলু ১৭ বছর ধরে সিএনজি চালান।

রাতারগুল পৌঁছে ছোট একটা নৌকায় উঠি। নৌকাচালক দুই ভাই, মোহাম্মদ সালমা ও রাশিদুল ইসলাম, তৃতীয় ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল ছুটি, তাই সংসার টানতে তারা এখন মাঝি। তাদের হাসিমাখা মুখ আর কষ্টের গল্প হৃদয় ছুঁয়ে যায় গভীরভাবে।

রাতারগুল, এক বিস্ময়কর জলাবন—পানিতে ডুবে থাকা গাছের মধ্যে চোখে পড়ে হিজল, বেত, মুর্তাগাছের আনাগোনা, কখনো কখনো গাছের ডালপালা ঠেলে বানাতে হয় পথ। এই বন যেন এক সজীব জলছবি—কখনো নিঃশব্দ, কখনো ছায়াময়।

সেখান থেকে অন্য একটি সিএনজি নিয়ে আমরা ছুটে যাই ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরের পানে। দূরে দেখা যায় ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ের মাথা। সিএনজিচালক বলেন, ‘ওই পাহাড়ের নিচে আপনাদের নিয়ে যাব।’ রাতারগুল থেকে সাদাপাথরের দূরত্ব অনেক। ঘণ্টাখানের মধ্যে পৌঁছে যাই ধলাই নদের তীরে, সাদাপাথরের স্বর্গে। গিয়ে দেখি, অসংখ্য মানুষ নৌকার টিকিটের জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরাও অনেক চেষ্টার পর টিকিট কাটতে সক্ষম হই।

নদীর জলে জ্বলজ্বলে পাথর—সূর্যের আলোয় তারা সোনার মতো জ্বলে। সবুজ পাহাড় আর শুভ্র পাথর মিলে গড়ে তোলে এক অপার্থিব দৃশ্য। স্মৃতির টুকরা হিসেবে কুড়িয়ে রাখি কিছু ছোট পাথর। ফেরার পথে সেখানে বিআরটিসি দোতলা বাস পাওয়া যায়। জনপ্রতি মাত্র ৭৫ টাকা ভাড়া। দুজনে দুটি টিকিটে ফিরে আসি আম্বরখানা।

মালনীছড়া চা-বাগান
ছবি: লেখক

পরদিন আমরা যাই মালনীছড়া চা-বাগানে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সুন্দর চা-বাগান। সঙ্গে গাইড আকাশ বাবু। ৩৫ বছর বয়স, বিয়ে করেননি। চা-বাগানে পাহারা দেন আর গাইড হয়ে পর্যটকদের গল্প শোনান। তিনি আমাদের চা-পাতা ও চা-বীজ তুলে দেন। কীভাবে রোপণ করতে হবে, তা–ও শেখান। বললেন, ‘একদিন আপনিও চা-বাগানের মালিক হবেন!’ গাইড খরচ ১২০-২০০ টাকা। চা–বাগানে হাঁটতে হাঁটতে দেখি—নীল আকাশ, সবুজ চা-পাতা আর সাদা মেঘ। সূর্যাস্তে সেই বাগান যেন এক স্বপ্নরাজ্য। চায়ের পাতায় লেগে থাকা শেষ রোদের কিরণে জেগে ওঠে এক রূপকথা।
নিস্তব্ধতায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর জোনাকি পোকার আলোয় রাত নামে এক পরাবাস্তব আবেশে।

সিলেট শুধু একটি জায়গা নয়, এ এক জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা। যেখানে নদী, পাহাড়, বন আর মানুষের গল্প মিলে তৈরি করে এক অনন্য কাব্য। স্মৃতির পাতায় চিরকাল জেগে থাকবে রাতারগুলের নৌকা, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর আর মালনীছড়ার পাতায় পাতায় লুকিয়ে থাকা জীবনের কাব্য।

কার্যনির্বাহী সদস্য, ফেনী বন্ধুসভা