বাবা দিবস
সেজবাবার কথা খুব মনে পড়ে
আমাদের বেড়ে ওঠায় বাবাদের অবদান অনেক। তাঁরা সেই অবদানের কথা প্রকাশ করতে চান না। সব সময় সন্তানের ছায়া হয়ে আড়ালে থাকতে পছন্দ করেন। সন্তান হিসেবে আমরাও বাবাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে যাই। ১৫ জুন ছিল বাবা দিবস। এ উপলক্ষে বাবাকে না বলা কথা লিখে পাঠিয়েছেন বন্ধুসভার বন্ধু ও পাঠকেরা।
১৯৭১ সালে সেজবাবা বিমলেন্দু বড়ুয়ার বয়স ছিল ২৩ বছর। এই বয়সেই মাতৃভূমি রক্ষায় চট্টগ্রামের ধলঘাট রেলস্টেশন ও বেঙ্গুরা রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী সাঁইজার পোলে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা হামলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ তখন মাত্র স্বাধীন হয়েছে। দেশ গড়ার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে অগ্রজ মেজদার (অধ্যাপক অমলেন্দু বিকাশ বড়ুয়া) পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। নিজ গ্রামে নবনির্মিত শিক্ষালয় রতনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষকতার যাত্রা শুরু হয়। ঠিক দেড় বছর পর ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ে ধাউরডেঙ্গা সারদা চরণ উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চক্রশালা কৃষি উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
অর্থসংকটে ভর্তি কোচিংয়ের টাকা দিতে পারছিলাম না। সেজবাবা সেদিন ১০ হাজার টাকা নিজের চিকিৎসা খরচ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন চিরকুমার। ভাইদের প্রতি ছিলেন অন্তপ্রাণ। তাঁর নিজের ছোট ভাই, আমার বাবা যখন নিজ পরিবার নিয়ে আর্থিক দীনতায় ভুগছিল, তখন তিনি আমাদের পরিবারের সব খরচ বহন করেছেন। বাবাকে ঋণমুক্ত করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছেন। গ্রাম থেকে মফস্সলে উঠিয়ে নিয়ে এসে আমি আর আমার দাদাকে শিক্ষিত করার সবটুকু প্রয়াস করেছেন। বাসাভাড়া, পরিবারের আনুষঙ্গিক খরচ, আমাদের স্কুলের ইউনিফর্ম থেকে শুরু করে গৃহশিক্ষকের বেতন পর্যন্ত তিনি বহন করতেন। আমাদের ছোট ছোট চাহিদা, স্বপ্ন বাস্তবে রূপদানের আসল রূপকার আমার সেজবাবা। তিনি জন্মসূত্রে আমাদের বাবা না হয়েও কর্মসূত্রে আমাদের বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন।
এখনো মনে পড়ে, আমি ক্লাস ফাইভে সরকারি বৃত্তি পাওয়ার পর সেজবাবা আমাদের সবার জন্য নানা পদের মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের সাফল্যে মা-বাবার আগে তাঁর খুশিটা ছিল সবচেয়ে বেশি। এসএসসিতে গোল্ডেন এ+ না পাওয়ায় মনটা একটু খারাপ ছিল, সেদিন সেজবাবা বলেছিলেন, ‘এ+ মানে এ+, সে আবার গোল্ডেন কিংবা ডায়মন্ড কী!’
ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে তখন তিনি কাতরাচ্ছেন। এদিকে অর্থসংকটে ভর্তি কোচিংয়ের টাকা দিতে পারছিলাম না। সেজবাবা সেদিন ১০ হাজার টাকা নিজের চিকিৎসা খরচ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
এমন নির্লোভ, নিরহংকার মানুষ কয়েক যুগ পেরিয়ে একবার জন্ম নেয় কি না, জানি না। তবে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ছিলাম যে এই মানুষটার ছায়ায় বড় হয়েছি। মাঝেমধ্যে ভাবি, তিনি না থাকলে না জানি আজ আমাদের কোথায় ঠিকানা হতো! সংসার নামের মাঝসমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া এক পরিবারকে তিনি উদ্ধার করেছেন, এসেছিলেন সাক্ষাৎ ঈশ্বরের দূত হয়ে। ২০১৩ সালে এই দেবসদৃশ মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের অর্জনের মুহূর্তগুলো তিনি দেখে যেতে পারেননি, এটাই আফসোস থেকে যাবে। এখনো ব্যর্থ হলে কিংবা অসহায় বোধ করলে, সেজবাবার কথা খুব মনে পড়ে।
চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া