বৃষ্টিভেজা নীড়ে ফেরা
অফিস থেকে বেরিয়ে পায়ের নিচে স্যাঁতসেঁতে পিচের পথ। ছাতা নেই। হাতে ব্যাগ। কাঁধে দিনের ক্লান্তি। মাথার ওপরের আকাশ টিপ টিপ করে কান্না শুরু করেছে। হাঁটছি। ধীর পায়ে। পেছনে অফিসের কাচের জানালায় আলোগুলো এক এক করে নিভে যাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই।
কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনে পৌঁছে দাঁড়ালাম লাইনে। প্ল্যাটফর্মেও বাইরের ধোঁয়াটে আলো এসে পড়ছে। চালের ওপর ঝমঝম শব্দ, ঠিক যেন গ্রামের বাড়ির সেই টিনের চালের স্মৃতি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের শরীর থেকেও ভেজা গন্ধ আসছে। কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও হাতে ছাতা— সবার চোখেই ক্লান্তির রেখা।
ট্রেন এসে দাঁড়ায়। দরজা খুলে যায় শব্দ করে। ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই জানালার পাশে। বাইরে কিছুই দেখা যায় না। শুধু ঝাপসা কাচ আর জলের রেখা। ট্রেন চলে, থামে, আবার চলে। শরীরের ভেতর একটা ভারী শূন্যতা জমে থাকে। মনে হয় যেন আমি ট্রেনের ভেতর নই, সময়ের ভেতর দিয়ে চলছি। প্রতিটি স্টেশন যেন একেকটা ছায়া।
মিরপুর ১০–এ এসে নামি। প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বুঝি, বৃষ্টি থামেনি, বরং বেড়েছে। ছুটে যাওয়া মানুষের ভিড়ে আমি একা। মাথা ভিজে চুল কপালে লেগে গেছে। গায়ের শার্টে জল ঢুকে চেপে বসেছে। প্যান্টটা ভিজে ভারী হয়ে উঠেছে, পা–টাও যেন ভারী হয়ে গেছে, কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। পিচঢালা পথটা যেন ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকা একখানা সমুদ্র।
রিকশা পাই না। কিছুটা হাঁটতে হয়। জলের ছাঁট উড়ে এসে চশমার ওপর পড়ে। ভিজে যাওয়া হাত দিয়ে মুছি, তবু ভেজা কমে না। হঠাৎ এক রিকশাওয়ালা দাঁড়ায়; বোঝে, আমার জরুরি যাওয়া। তবু যেন সে দৈনিকের চেয়ে বিশ টাকা বেশি নিয়েই ছাড়বে। কী আর করার, উঠে বসি। পেছনের সিটে বসতেই ঠান্ডা ভিজে যাওয়া কুশনের স্পর্শে গা কেঁপে ওঠে।
বৃষ্টির ফোঁটা এখনো পড়ছে, আমার গায়ে, মুখে, বুকের ওপর। রিকশা চলছে ধীরে। রোদের দিনে এই রাস্তায় ধুলা ওড়ে, আর আজ জল। রাস্তাগুলো যেন একেকটা নদী!
বাসার সামনে নেমে পা রাখতেই টের পাই, জুতা ভেজা, পা–ও ভেজা, হৃদয়ও কি খানিকটা ভিজে গেল?
বাসার ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালাই। আয়নায় দেখি, ভেজা আমি। তবু ভেতরে কোথাও শুকনো রয়ে গেছে কিছু। বৃষ্টির রাতে, ক্লান্ত শরীরে, ফিরেছি ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটু হারিয়েও গেছি।