যেখানে মানুষই মানচিত্র: বন্ধুত্বের আলোয় লেখা তিনটি দিন

গণ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরাছবি: লেখকের সৌজন্যে

কিছু দিন থাকে, যেগুলো সময়ের নিয়ম মানে না। শুরু হয় একটি তারিখে, কিন্তু শেষ হয় না সেখানে। মানুষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। নিঃশব্দে। ধীরে। অনেক দিন ধরে।

গাজীপুরের মৌচাক এমনই এক জায়গা হয়ে উঠেছিল। জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণকেন্দ্রের বিস্তৃত মাঠ, কুয়াশায় ঢাকা সকাল, দূর থেকে ভেসে আসা জাতীয় সংগীতের সুর। পায়রা উড়ল আকাশে, রঙিন বেলুন মিশে গেল মেঘের সঙ্গে। সেই মুহূর্তে বোঝা গেল, এটি কোনো সাধারণ সমাবেশ নয়। এটি একটি মিলনের গল্প, বহুদিনের অপেক্ষার পর নতুন করে শুরু হওয়া এক যাত্রা।

দীর্ঘ পাঁচ বছর পর প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় সমাবেশ আবার ফিরে এল। ‘আমরা সবাই বাংলাদেশ’ ছিল স্লোগান। কিন্তু সেই বাক্য শুধু ব্যানারে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মাঠে নামতেই তা রূপ নিয়েছে অনুভবে। দেশের ৬৪টি জেলা ও ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা প্রায় ১ হাজার ২০০ তরুণ-তরুণী এখানে জড়ো হয়েছিলেন। তাঁদের পরিচয় ছিল ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু তাঁবুর নিচে ঢুকতেই সেই পরিচয়গুলো গলে গেছে। সেখানে সবাই ছিল কেবল বন্ধু।

শীত ছিল, কুয়াশা ছিল, কিন্তু তার চেয়েও প্রবল ছিল মানুষের উষ্ণতা।

২৫ তারিখের রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে মৌচাকের দৃশ্য। সারি সারি তাঁবু উঠে দাঁড়ায়। আলো জ্বলে ওঠে। মানুষের হাঁকডাক, হাসি আর ব্যস্ততার ভেতর ধীরে ধীরে তৈরি হয় এক অদ্ভুত ঘরবাড়ি। শীত ছিল, কুয়াশা ছিল, কিন্তু তার চেয়েও প্রবল ছিল মানুষের উষ্ণতা। এক তাঁবু থেকে আরেক তাঁবুতে যাওয়া মানে ছিল নিজের মানুষদের খুঁজে বের করা।

দিনের বেলা কাটে কথা আর ভাবনায়। বন্ধুসভার পথচলা, সমাজের পাশে দাঁড়ানোর গল্প, আগামী দিনের স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে আলোচনায়। কেউ শোনেন, কেউ বলেন, কেউ চুপচাপ বসে সবটুকু মনে গেঁথে নেন। এই সময়গুলো ছিল শেখার, বোঝার আর নিজের ভেতরে নতুন প্রশ্ন জাগানোর।

সন্ধ্যা নামলেই মাঠের রং পাল্টে যায়। আলো-আঁধারির মধ্যে গান ভেসে আসে। নাচের তালে তালে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। মানুষের ভিড়ে ভিড়েও একধরনের নীরবতা থাকে, যেটা কেবল আনন্দের। ছবি তোলা, গল্প করা, বহুদিন পর দেখা হয়ে যাওয়া মানুষদের আলিঙ্গন, নতুন পরিচয়ের উচ্ছ্বাসে সন্ধ্যাগুলো কেটে যায় চোখের পলকে।

এই তিন দিনে বন্ধুসভা কেবল আনন্দ দেয়নি, দিয়েছে একটি উপলব্ধিও।

রাত গভীর হলে তাঁবুগুলো হয়ে ওঠে ছোট ছোট গল্পের ঘর। কোথাও আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে থাকা, কোথাও চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। কোথাও গান, কোথাও নিঃশব্দ আড্ডা। খোলা আকাশের নিচে একসঙ্গে থাকার এই অভিজ্ঞতা অনেকের জীবনে ছিল নতুন, আবার অনেকের জন্য ছিল দীর্ঘদিন পর ফিরে পাওয়া কোনো পুরোনো আনন্দ।

এই তিন দিনে বন্ধুসভা কেবল আনন্দ দেয়নি, দিয়েছে একটি উপলব্ধিও। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আলো বন্ধুসভার আহ্বায়ক নুসরাত জাহানের ভাষায়, এই মহাসমাবেশ ছিল আনন্দ, বন্ধুত্ব ও শেখার এক অনন্য মিলন। ক্যাম্পিং আর ক্যাম্পফায়ারের অভিজ্ঞতা বন্ধনকে করেছে আরও দৃঢ়, আর আলোচনা থেকে পাওয়া ভাবনা ভবিষ্যতের পথচলাকে করবে আরও দায়িত্বশীল।

ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক আকিফ বিন সাঈদের কথায়, ঘন কুয়াশার মধ্যেও দেশের সব প্রান্তের মানুষ এখানে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। দিনভর আয়োজন, রাতভর আড্ডা আর হাজারো মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা সখ্য মিলিয়ে এই তিন দিন হয়ে উঠেছিল ভালোবাসায় ভরা এক সময়।

বন্ধুসভার ষষ্ঠ জাতীয় বন্ধু সমাবেশ রয়ে গেছে বন্ধুত্বের ভাষায় লেখা একটি সময় হয়ে।

চুয়াডাঙ্গা বন্ধুসভার সহসভাপতি মাহমুদ আল আরাফাতের অনুভূতিতে ধরা পড়ে এই সমাবেশের সবচেয়ে মানবিক দিক। এখানে কেউ পর নন। সবাই আপন। এক তাঁবু থেকে আরেক তাঁবুতে যাওয়া যেন নিজের উঠানে হাঁটা। এই অনুভবই বন্ধুসভার মূল শক্তি।

শেষ দিনের দুপুরে বন্ধুরা মাঠে জড়ো হন। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। মানুষ দিয়েই মানুষকে আঁকা হয়। বন্ধুসভার লোগো গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। এটি ছিল একধরনের প্রতীক। মানুষ দিয়েই দেশ গড়া যায়, এই বিশ্বাসের নীরব ঘোষণা।

তারপর শুরু হয় ফেরা। কেউ ব্যাগ কাঁধে নেন, কেউ শেষবারের মতো মাঠের দিকে তাকান। তিন দিনের হাসি, গল্প আর উষ্ণতা সঙ্গে নিয়ে সবাই ফিরতে থাকেন নিজ নিজ জীবনে। কিন্তু কেউই আগের মতো থাকেন না।

প্রথম আলো বন্ধুসভার ষষ্ঠ জাতীয় বন্ধু সমাবেশ তাই শেষ হয়ে যায়নি। এটি রয়ে গেছে মানুষের ভেতরে। বন্ধুত্বের ভাষায় লেখা একটি সময় হয়ে। যেখানে দেশ মানে কেবল মানচিত্র নয়, মানুষও।
আমরা সবাই বাংলাদেশ।

বন্ধু, গণ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা