হেমন্তের বিকেলের কোমল আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় আর্কাইভস মিলনায়তনের সামনে তখন জমতে শুরু করেছে তরুণ মুখের উচ্ছ্বাস। ভেতরে পা রাখতেই মনে হলো—আজ যেন বন্ধুত্ব নিজেই উৎসবে সাজ সাজ রং লাগিয়েছে। ‘সত্য সাহসে অপরাজেয় বন্ধুত্ব’ স্লোগানে ১৩ নভেম্বর প্রথম আলো বন্ধুসভার ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনন্দ অনুষ্ঠানের পর্দা উঠল জাতীয় সংগীতের শক্তিময় সুরে।
মেঘা খেতান, সরকার একান্ত ঐতিহ্য, দুর্জয় কুমার সরকার, রিজওয়ানুল রিজু ও কাভি সিকান্দারের কণ্ঠে জাতীয় সংগীত মিলনায়তনে যেন এক নতুন উদ্দীপনার জন্ম দিল। এরপরই শুরু হয় রঙিন সাংস্কৃতিক পর্ব। বন্ধুসভার থিম সং—‘ও বন্ধু, সুন্দর একটি বাংলাদেশ আমরা গড়ব সবাই’—বেজে উঠতেই পাঁচ তরুণ-তরুণী নৃত্যের ছন্দে ছড়িয়ে দিলেন নতুন স্বপ্ন দেখার প্রত্যয়। নৃত্যে অংশ নেন হোসাইন ইসলাম, জাকিয়া লিমা, মাসিয়াত দিহান, দোলা রহমান ও স্নিগ্ধা পালমা।
তারপর একে একে মঞ্চে সাজতে থাকে ছন্দ, সুর, আলোর উজ্জ্বল খেলা। ‘রাঙামাটির রঙে চোখ জুড়ানো’ থেকে শুরু করে ‘আবো নওদারিটা মরিয়া’র মধুর ছন্দ—গানের আবহে নৃত্য উপহার দেন ড্যাফোডিল বন্ধুসভার বন্ধু ইশিতা মণ্ডল, মাহিয়া তাবাসসুম ও পারমিতা নাগ। ‘আলগা করো গো খোপার বাঁধন’ আর ‘সূর্যোদয়ে তুমি, সূর্যাস্তে তুমি’র রূপ লুকানো গানগুলো যেন হেমন্তের সন্ধ্যায় নতুন গল্প বলছিল।
সেই গল্পের মধ্যেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে আলো। জাতীয় পর্ষদের সহসভাপতি মাহবুব পারভেজ যখন আবৃত্তি করলেন সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী কবিতা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, মিলনায়তন নিস্তব্ধ হয়ে শুনল বঞ্চনার বিরুদ্ধে অগ্নিস্বরের সেই কবিতার আহ্বান।
তারপর আবার নৃত্যের দোল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্ধুসভার হোসাইন ইসলাম ও কেরানীগঞ্জের তাসমিয়া তিয়ানা ‘সুন্দরী কমলা নাচে’ গানের তালে যেন মঞ্চকে রঙিন করে তুললেন। একক নৃত্যে ‘মাদল বাঁশি বাজা তালে তালে’ গানের ছন্দে মুগ্ধতা ছড়ালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার মাসিয়াত দিহান।
মঞ্চ যখন সংগীতে ভাসছে, তখন বন্ধুর গান প্রতিযোগিতা ২০২৫-এর সেরা শিল্পীরা একে একে ধরে রাখলেন শ্রোতাদের মনোযোগ। দুর্জয় কুমার সরকারের কণ্ঠে ‘গ্রামের নওজোয়ান’, রিজওয়ানুল রিজুর ‘বন্দে মায়া লাগাইছে’, সরকার একান্ত ঐতিহ্যের আবেগমথিত ‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে’—সব মিলিয়ে মিলনায়তন ভরে উঠল সুরের প্রতিধ্বনিতে। ঢাকা মহানগরের কাভি সিকান্দারের কণ্ঠে ‘পূর্ণতা’ যেন সন্ধ্যার আবহে আরেকটি কোমল পরত যোগ করল।
এদিকে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার বন্ধু মেঘা খেতান যখন গাইলেন ‘ওরে সাম্পান ওয়ালা’ ও ‘তুমি কি সাড়া দেবে’, তখন দর্শকসারি দুলে উঠল তাল মিলিয়ে। অনিক সরকারের কণ্ঠে ‘নিজামুদ্দিন আউলিয়া’ ও ‘কানার হাট বাজার’ দর্শকদের আবারও ফিরিয়ে নিয়ে গেল লোকসংগীতের রঙিন মাটির ঘ্রাণে।
আর সবশেষে, যেটির জন্য অনেকে অপেক্ষা করছিলেন—র্যাম্প প্রদর্শনী। মেঘা খেতানের নির্দেশনায় তরুণ বন্ধুদের এই উপস্থিতি যেন ছিল আত্মবিশ্বাস, নান্দনিকতা এবং শিল্পবোধের এক চমৎকার সমাবেশ। তানভীর আলিফ, স্নিগ্ধা পাল, তানভীর হাসান, জাকিয়া লিমা, সাজ্জাত হাসান, ফাতেমা তিশা, নাঈমা সুলতানা, মুশফিকুর রহমান, আশফাক আদি ও দোলা রহমান মঞ্চজুড়ে ছড়িয়ে দিলেন তারুণ্যের সাবলীল পদচারণা। যেখানে ফুটে উঠেছে বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
এক সন্ধ্যায় এত সুর, নৃত্য, রং, আবেগ, বন্ধুত্ব—সব মিলিয়ে মনে হলো, বন্ধুসভার জন্মদিন শুধু উদ্যাপন নয়, বরং এক আত্মিক মিলনমেলা। এখানে বন্ধুত্বই শিল্প, বন্ধুত্বই গান, বন্ধুত্বই আলো; আর এই আলোয় তরুণেরা খুঁজে পায় নতুন দিনের পথরেখা।