লোকগানে ঈদ–আনন্দ

দলীয় কণ্ঠে ভৈরবের বন্ধুদের গান পরিবেশনা
ছবি: আনাস খান

বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। আঞ্চলিক প্রথা, আচরণ, ভাব, ধারা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আলাদা করেছে অঞ্চলগুলোকে। লোকসংগীত আঞ্চলিক স্বকীয়তা তৈরিতে আলাদা ভূমিকা রেখেছে। গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সংগীতে। লোকসংগীত বাংলাদেশের সংগীতের একটি অন্যতম ধারা। এই ধারায় রয়েছে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি, গম্ভীরা, বাউল, কবিগান, আলকাপ ইত্যাদি। লোকসংগীত বাংলার নিজস্ব সংগীত।

দিনটি ৭ জুলাই, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত ৮টা। প্রথম আলো ভৈরব অফিস থেকে একদল তরুণ-তরুণীর সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হলো বিখ্যাত ভাটিয়ালি গান ‘কলকল ছলছল নদী করে টলমল/ ঢেউ ভাঙে ঝড় তুফানেতে’। বর্ষার পানিতে যখন হাওর-বাঁওড়, নদীনালা ভরে উঠত, তখন পাল তুলে বইঠা হাতে আনন্দের সুরে গান করতেন মাঝিরা। ভাটি অঞ্চলের মাঝিরাই ছিলেন মূলত এসব গানের বাহক।

ভৈরব বন্ধুসভার পরিবেশনায় ‘লোকগানে ঈদ-আনন্দ’ শিরোনামে সংগীতানুষ্ঠানের সূচনা হয় সমবেত কণ্ঠে গানটি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। বন্ধুদের ঈদের আনন্দকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই এ আয়োজন। এরপর স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক তাবাসসুম কায়সার শোনান হাসন রাজার লেখা বিখ্যাত গান ‘নিশা লাগিল রে/ বাঁকা দু’নয়নে নিশা লাগিল রে’। বন্ধু মোশারফ রাব্বি গেয়ে শোনান ‘সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা’ ও ‘যেজন প্রেমের ভাব জানে না’ গান দুটি।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে/ কে আইসা দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে’ গানটি গেয়ে শোনান সহসভাপতি সানজিদা সিদ্দিকা। ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চন্দ্রকথা’ সিনেমায় গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। গানের পাশাপাশি চলছিল আলোচনা পর্ব। ঈদের আনন্দ নিয়ে বন্ধুদের কাছে প্রতিক্রিয়া নেন সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসেন ও নাফিস রহমান। দুজনেই ছিলেন সঞ্চালক।

ভৈরব বন্ধুসভার লোকগানে ঈদ–আনন্দ
ছবি: আনাস খান

গান নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান উপদেষ্টা আলাল উদ্দিন, রাকিব হোসাইন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রায়হান দ্বীপ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন, কার্যনির্বাহী সদস্য আফিসা আলী। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সুমন মোল্লা বলেন, ‘ভৈরব বন্ধুসভা বছরব্যাপী বেশ কিছু আয়োজন করে। তার মধ্যে গানের আয়োজনটির সূচনা হয় ২০২১ সালে তৎকালীন সভাপতি ইকরাম বখশ ও সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াংকার হাত ধরে। গানের অনুষ্ঠান নিয়ে বন্ধুসভার বন্ধুদের আগ্রহ-উদ্দীপনা কাজ করে বলেই আমরা এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি। সামনের দিনগুলোতে বাংলা সংগীত ভুবনের আরও বেশ কয়েকটি ধারার গান নিয়ে অনুষ্ঠান হবে।’

উপদেষ্টা ওয়াহিদা আমিন বলেন, ‘লোকগানে ঈদ-আনন্দ’ আড্ডায় প্রিয়মুখগুলোর সঙ্গে দারুণ একটা সময় পার করেছি। প্রতিটি গান আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ফেলে আসা দিনগুলোতে। চমৎকার আয়োজনটির জন্য তোমাদের ধন্যবাদ।’

এরপর বন্ধুরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত বিয়ের গীত ‘আইলা রে নয়া দামান আসমানের তেরা/ বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানের নেড়া/ দামান বও দামান বও’। সত্তর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট থেকে এটি প্রচার হয়ে আসছে। সাংস্কৃতিক সম্পাদক আরতি পাল শোনান লালনগীতি ‘মিলন হবে কত দিনে/ আমার মনের মানুষের সনে’ গানটি। বন্ধু জান্নাতুল প্রীতি শোনান ‘কি জ্বালা দিয়ে গেলা মোরে’। সহসভাপতি সানজিদা সিদ্দিকা ও মোশারফ রাব্বি দ্বৈত কণ্ঠে শোনান ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা/ তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা’ গানটি। তাবাসসুম কায়সার ও আরতির কণ্ঠে ভেসে ওঠে ‘একখান পান চাইলাম পান দিলে না/ তোমার সনে কিসের পিরিতি’ গানটি।

ডক্টরস ক্লাব ভৈরবের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান কবির বলেন, ‘ভৈরব বন্ধুসভার রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী, মঞ্চনাটকসহ বেশ কয়েকটি আয়োজনে আমি সরাসরি উপস্থিত ছিলাম। মুদ্রিত বই পড়ার নিয়মিত আসর “পাঠচক্র” আমার বেশ ভালো লাগে। আজকের ব্যতিক্রমধর্মী গানের আয়োজনে আসতে পেরে বেশ ভালো লাগছে।’

বন্ধুদের সমবেত কণ্ঠে আবারও ধ্বনিত হয় ‘বকুল ফুল বকুল ফুল/ সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি’ গানটি। একে একে বন্ধুরা মোট ১২টি গান গেয়ে শোনান। অন্যদের মধ্যে কণ্ঠ দেন মাহমুদা তমা, সামিয়া সিদ্দিকা, অর্থ সম্পাদক মানিক আহমেদ, জেন্ডার ও সমতা সম্পাদক তানশি নাহার, প্রচার সম্পাদক মহিমা মেধা, সাংস্কৃতিক সম্পাদক ফ্রমি হক, বন্ধু হান্নান হিমু, জিহাদ খান, মোজাম্মেল অনুপম ও প্রাপ্তি ঘোষ। যন্ত্রসংগীতে ছিলেন লিটন মোল্লা ও জাকির হোসেন।

সভাপতি নাহিদ হোসাইন বলেন, ‘বাংলা সংগীতের ইতিহাসে যেসব ধারার গানগুলো বিশেষ স্থান দখল করে আছে, তার মধ্যে লোকজ ধারা একটি। যুগ যুগ ধরে গানগুলো এখনো শ্রোতাদের মনের খোরাক মিটিয়ে আসছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখন আর কালজয়ী গান সৃষ্টি হয় না। ভাইরাল এবং রিমিক্স নামক শব্দের মায়াজালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। বাংলা গানের সোনালি অতীত ফিরে আসুক, এই প্রত্যাশা।’

পুরো আয়োজনটি ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ সম্প্রচার হয়। লাইভটিতে সহযোগিতা করেন তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক রাসেল আহমেদ।