চলো জ্যোৎস্নায় ভিজি

নীলু ও মিসির আলি চরিত্রে জান্নাতুল ফেরদৌস ও সালমান ফারসি
ছবি: তানজিলুল প্লানা

একটি ছবির ফ্রেম। সেখানে মমতা দিয়ে রংতুলির ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হিমু, মিসির আলি ও শুভ্রকে। আর তাদের আশপাশে জুড়ে আছে মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদারসহ ২৭টি গল্পের নাম। দেখে বোঝা যায়, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরেই তৈরি এই ফ্রেম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধু জান্নাতুল ফেরদৌস এঁকেছেন ছবিটি। নিয়ে আসেন বন্ধুসভার ‘চলো জ্যোৎস্নায় ভিজি’ অনুষ্ঠানে। যে–ই দেখেন, খুশি চিকমিক করে চোখেমুখে।

এদিকে সানগ্লাসে ঢাকা চোখ, কপালজুড়ে চিন্তার ছাপ নিয়ে আঙুল দোলাতে দোলাতে প্রবেশ করলেন এক যুবক। বুঝতে বাকি রইল না তিনি বাকের ভাই। ঠিক যেমনটা দেখা মিলেছিল কোথাও কেউ নেই নাটকে। মুনাও এসে ভিড়লেন বাকেরের পাশে। তাঁদের ঘিরে পড়ল ছবি তোলার হিড়িক।

একে একে এলেন একাধিক হিমু-রুপা। নীল শাড়ির রুপা আর হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত যে হিমুদের রেখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ, তাঁদের বিস্তার যেন একটু বেশি।

হুমায়ূন আহমেদের ৭৫তম জন্মোৎসব বলে কথা। ১৩ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার প্রথম আলো কার্যালয়ে বন্ধুদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। সপ্তাহখানেক আগে থেকে প্রস্তুতি নেন বন্ধুরা। হুমায়রা আনজুম, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার এই বন্ধু বারবার আওড়াচ্ছিলেন রুপার ডায়ালগগুলো। কোনোভাবেই যেন বের হতে পারছিলেন না রুপার চরিত্র থেকে। তাঁর মতো চরিত্রের মধ্যে ডুবে ছিলেন নীলু ও মিসির আলি।

ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার উপদেষ্টা মাহবুব পারভেজ ও খাদিজা জান্নাত পরিবেশন করেন একটি রম্য নাটিকা
ছবি: তানজিলুল প্লানা

জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিকের সঞ্চালনায় সেদিন মূল আয়োজন শুরু হয় বন্ধুদের হুমায়ূন–বন্দনা পরিবেশনা দিয়ে। খাদিজা জান্নাতের নেতৃত্বে এতে অংশ নেন হুমায়রা আনজুম, তানজিলুল প্লানা, গাজী আসিফ, সাইদুল হাসান, আলাদিন আসাদ, তাহসিন মাজেদ, শারমিন তিশা ও রবিউল হাসান।

এরপর মঞ্চে ওঠেন হিমু-রুপা, কুসুস-মতি, মুনা–বাকের ভাই, নীলু ও মিসির আলি। ‘ভালোবেসে আমি নিজেকেই বিলিয়েছিলাম’ শিরোনামের পরিবেশনায় কালজয়ী এসব চরিত্রে নিজেদের উপস্থাপন করেন হুমায়রা আনজুম-গাজী আসিফ, খাদিজা জান্নাত-গাজী আনিস, সাদিয়া সূচনা–তানজিলুল প্লানা, জান্নাতুল ফেরদৌস ও সালমান ফারসি।

আয়োজনে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নাটকের সংলাপ নিয়ে হয় পরপর দুটি নাটিকা। ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি সোলায়মান কবিরের সঙ্গে প্রথমটিতে অংশ নেন শাহিদা আলম ও হুমায়রা আনজুম। দ্বিতীয়টিতে ছিলেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার উপদেষ্টা মাহবুব পারভেজ ও খাদিজা জান্নাতের হাস্যরসাত্মক পরিবেশনা। স্বামী-স্ত্রীর সমুদ্রবিলাস ও এর মধ্যে ঘটে যাওয়া এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি রম্য পরিবেশনায় অংশ নেন তাহসিন মাজেদ, শারমিন তিশা ও ওয়াসিমা তাসনিম। হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন গল্পের চরিত্র নিয়ে একটি র‌্যাম্প প্রদর্শনী বন্ধুদের মনে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। যেখানে অংশ নেন ৯ বন্ধু।

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এ ধরনের আয়োজন দেশে খুব একটা হয়নি উল্লেখ করে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায় বলেন, ‘বন্ধুসভা সব সময় সৃষ্টিশীল ও ব্যতিক্রম আয়োজন নিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। আমরা হুমায়ূন আহমেদের এই আয়োজনে এবার একটি বার্তা দিয়েছি, তা হলো, মাসে অন্তত একটি করে হলেও বই পড়ব। আমাদের প্রিয় লেখক যে পড়ুয়া জনগোষ্ঠী তৈরি করে রেখে গেছেন, তা যেন অব্যাহত থাকে।’ নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ বলেন, ‘বন্ধুসভার কোনো অনুষ্ঠান মানেই তার মধ্যে থাকে ইতিবাচক বার্তা, যা অন্যদের করে অনুপ্রাণিত। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমাদের যে আয়োজন, তা এই প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে গুণী এই কথাসাহিত্যিক-নির্মাতা তাঁর কলমের মাধ্যমে বাঙালি জাতির জন্য শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার বার্তা দিয়েছেন। এমনকি তিনি আমাদের জীবনযাপনে মিশে গেছেন।’

বাকের ভাই চরিত্রে তানজিলুল প্লানা
ছবি: মাইদুল ইসলাম

একটি পড়ুয়া তরুণ জনগোষ্ঠী তৈরির পেছনে হুমায়ূন আহমেদের মতো ইদানীং আর কেউ অবদান রাখতে পারছেন না উল্লেখ করে বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের কলমে এক অন্য রকম জাদু ছিল, যা টেনে এনেছে তরুণ পাঠকদের। তরুণেরা আবিষ্ট হয়েছেন পড়ার প্রতি।’

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি সোলায়মান কবির সোহেল বলেন, ছোট ছোট চরিত্রকে নান্দনিক রূপ দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। মিসির আলিকে বিজ্ঞানী বোদ্ধারূপে, হিমুকে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস জাগাতে তিনি তৈরি করে গেছেন। পড়ার সময় পাঠক ধরে রাখার ক্ষেত্রে তিনি অতুলনীয়।

আর হুমায়ূন আহমেদের নাট্যচরিত্রে আকৃষ্ট হয়ে হিমুরূপী অনেক তরুণ ছড়িয়ে আছে উল্লেখ করে বন্ধুসভার উপদেষ্টা মাহবুব পারভেজ বলেন, একসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাত-বিরাতে অনেক হিমু বের হতেন। খালি পায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে কখনো-সখনো জোছনা দেখতেন তাঁরা। এমনকি আমার এক শিক্ষার্থী ছিল, যে হিমু সেজে রাতে বের হয়ে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিল। এসব ঘটনা নিঃসন্দেহে জানান দেয়, হুমায়ূন আহমেদ ঠিক কতটা মানুষের ভেতরে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছিলেন।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদ