স্মৃতির প্রাঙ্গণে জীবনের উচ্ছ্বাস ও বন্ধুত্বের অনির্বচনীয় মহিমা

অনুষ্ঠান শেষে সবাই
ছবি: বন্ধুসভা

শিক্ষাজীবনের সোনালি পথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পা রাখি নির্দয় বাস্তবতার শহরে, যেখানে ভোর মানে ঘড়ির অ্যালার্ম, দুপুর মানে ব্যস্ততার গুঞ্জন, আর সন্ধ্যা মানে ক্লান্তি ভরা আলো-অন্ধকার খেলায় গৃহবন্দী মানুষের নীরব হাঁসফাঁস। এই যান্ত্রিক সময়ের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে কখনো হঠাৎ বুকের ভেতর খচখচ করে ওঠে আগের দিনগুলো—ক্যাম্পাসের রোদ, বন্ধুত্বের হাসি, ক্যানটিনের চায়ের ধোঁয়া, লাইব্রেরির নীরবতা, খোলা মাঠের দৌড়, আর রিকশাভ্রমণে শেষবেলার কাঁদা-ঘেরা পথ। মনে পড়ে যায়—‘কত ভালো ছিলাম, কত কাছাকাছি ছিলাম!’

আর তখনই প্রাণের টানে মন ফিরে যেতে চায় সেই পুরোনো উঠোনে, চিনে রাখা গাছতলায়, স্মৃতি জমে থাকা বেঞ্চির ওপর। সেই টানেই, প্রতিবছরের মতো এবারও ড্যাফোডিল বন্ধুসভা আয়োজন করল নবীন-প্রবীণদের অনন্য মিলনমেলা ‘এসো মিলি প্রাণের টানে ২০২৫’।

২৪ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার ঢাকার আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বনমায়া—সবুজ নীরবতার এক স্বর্গ। প্রিয় ক্যাম্পাসের কোলে প্রিয় মুখগুলোকে আবার দেখার উচ্ছ্বাস, বুকের গভীরে জমে থাকা স্মৃতি যেন সেই সকালের বাতাসেই নেচে ফিরছিল। দিনটি ছিল ছুটির, তবু ব্যস্ত জীবনের টানটান রুটিন ভেঙে সাবেক সদস্যরা ছুটে এসেছিলেন— কেউ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, কেউ ঢাকা শহরের নানা প্রান্ত থেকে, কেউবা অনেক দিন না দেখা ক্যাম্পাসের পথে হাঁটার আগ্রহে রাতেই ঠিক করে রেখেছিলেন পোশাক।

প্রীতি ফুটবল ম্যাচের একটি দৃশ্য
ছবি: বন্ধুসভা

বন্ধুসভা তাঁদের বরণ করে নিল স্নেহ, উচ্ছ্বাস ও অসীম মমতার উষ্ণতায়। ছিল প্রীতি ফুটবল খেলা, মেয়েদের জন্য খেলাধুলা, ক্যারিয়ার ও কমিউনিকেশন সেমিনার এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সহযোগিতায় ছিল ঈশিতা মন্ডল কালেকশনস ও আথ আর্ট ক্যাফে, উত্তরা; যা পুরো দিনটিকে করে তুলেছিল আরও রঙিন।

সকাল নয়টায় রৌদ্রের সোনালি আলোয় শুরু হয় উৎসব। ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল ফিল্ডে জমে ওঠে বন্ধুত্বের উচ্ছ্বাস—আহ্বান জানায় নীল আকাশ, কচি ঘাস, আর সকালবেলার হিমেল বাতাস। সাবেকদের আগমন, বর্তমানের হৃদয়ভরা বরণ, পরিচয়ের আনন্দ, হাসি-আড্ডা—প্রতিটি মুহূর্ত যেন বন্ধুত্বের খাতা থেকে তুলে আনা অমূল্য পৃষ্ঠা।

সবাই নাশতা শেষে দলীয় টি-শার্ট পরে মাঠের দিকে অগ্রসর হয়। দুই দলে বিভক্ত হয়ে শুরু হয় প্রীতি ফুটবল খেলা। লাল দলের অধিনায়ক সহসভাপতি ইনছান কবির, সবুজ দলের অধিনায়ক সহসভাপতি রাকিবুল হক। সভাপতি নাজমুল হাসান শিস বাজিয়ে উদ্বোধন করেন খেলা, রেফারির দায়িত্বে বন্ধু রাইসুল ইসলাম।

ফুটবল ম্যাচের পর ড্যাফোডিল বন্ধুসভার বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

প্রথম অর্ধে পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়ে যায় সবুজ দল ১-০ তে। শেষ অর্ধে লাল দলের দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন—গোলের পর গোল, উত্তেজনার ঝড় আর শেষে রোমাঞ্চকর ২-২ ড্র। একই সময়ে সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া লিমা, সহসভাপতি ঈশিতা মন্ডল ও দপ্তর সম্পাদক পারোমিতা নাগের তত্ত্বাবধানে চলে মেয়েদের খেলাধুলা পর্ব।

এরপর সবাই ছুটে যায় সুইমিংপুলে—হাসি, জল, উচ্ছ্বাস, জলকেলির শব্দে চারদিক মুখরিত। জুমার নামাজ শেষে আবার সবাই একত্রিত; দুপুরের আলোতেও বন্ধুত্বের হাসি ঝলমল করে।

বেলা দুইটায় গ্রিন গার্ডেনে শুরু হয় মধ্যাহ্নভোজ। ছিল গ্রামের বিয়েবাড়ির মতো উৎসবের আমেজ— টেবিলভর্তি খাবার, সবার মুখে উচ্ছ্বাস, খাওয়া শেষে ছবি আর স্মৃতি বন্দী করা গল্প। খাওয়া শেষে সবাই চলে যায় বনমায়ায়। বাতাসে পাতার মর্মর, দূরের পাখির ডাক, আর বন্ধুদের প্রাণভরা হাসি—যেন প্রকৃতি নিজেই উদ্‌যাপন করেছে এই মিলন।

নৃত্য পরিবেশনা
ছবি: বন্ধুসভা

বেলা তিনটায় শুরু হয় ক্যারিয়ার ও কমিউনিকেশন সেমিনার। বক্তব্য দেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাবেক সহকারী অধ্যাপক ইজাজ-উর-রহমান সজল। তিনি ড্যাফোডিল বন্ধুসভার একজন অ্যালামনাই, বর্তমানে দ্য প্রিমিয়াম হোমস লিমিটেডের ডেপুটি সিইও হিসেবে কর্মরত। ইজাজ-উর-রহমান সজল বলেন, ‘জীবনে ক্যারিয়ার সেট করতে হলে দরকার তিনটি জিনিস—নেটওয়ার্কিং, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও কমিউনিকেশন।’

জিনলাইট বাংলাদেশের হেড অব মার্চেন্ডাইজ মুয়াজ হোসেন বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে মেশার মধ্য দিয়েই তৈরি হয় কমিউনিকেশন। আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশি—বড় ও ছোট সবাই কোনো না কোনো দিকে অভিজ্ঞ। এই চলাচলের মধ্যেই আমাদের কমিউনিকেশন বিল্ডআপ করতে হবে।’ তিনিও ড্যাফোডিল বন্ধুসভার অ্যালামনাই।
এই পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন বন্ধু রওশন রিমি ও রিফাতুল ইসলাম।

গান পরিবেশনা
ছবি: বন্ধুসভা

বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। তখন সূর্য ঢলে পড়ে গাছের শাখায় শাখায়। শুরু হয় নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি ও র‍্যাম্প প্রদর্শনী—শিল্প যেন এক স্রোতের মতো ছড়িয়ে গেল পুরো বনমায়াজুড়ে। এই পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন বন্ধু শেখ মোহাম্মদ মাহাতির ও মরিয়ম খাতুন।

একদিকে চলে পডকাস্ট—সাবেকদের গল্প, মজার প্রশ্ন, স্মৃতির টান। এই পর্ব পরিচালনা করেন পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক সালমান ফারসি ও মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক ইশরাত হিমা। অন্যদিকে সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসাভভির সাকির ও সাবেক সভাপতি সাব্বির আহমেদ বিক্রি করেন লটারি। তাঁদের ব্যতিক্রমী উপস্থাপনায় হাসি আর মজায় মুখরতা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

সন্ধ্যায় আজানের বিরতি শেষে অনুষ্ঠিত হয় জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক ওরিয়া তাজরিমিনের পরিচালনায় র‍্যাম্প প্রদর্শনী—আলো, সুর, পদচারণ, পরিবেশনার ছন্দে মুগ্ধতা ছড়ায়।

সার্টিফিকেট বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আনন্দ উৎসব
ছবি: বন্ধুসভা

ড্যাফোডিল বন্ধুসভার যেকোনো অনুষ্ঠান মানেই বর্তমানদের সঙ্গে সাবেকদের মিলনমেলা। আর এই অনুষ্ঠান সম্পূর্ণই সাবেকদের নিয়ে। কর্মব্যস্ত দিনের সব ব্যস্ততা একপাশে রেখে বন্ধুত্বের টানে ছুটে আসেন অনেকেই। সাবেক সভাপতি আহমেদ পাভেল বলেন, ‘এই আয়োজন আমাদের টানে। বছরের অপেক্ষা শেষে আমরা ফিরে আসি—ক্যাম্পাসের ঘ্রাণ, বন্ধুত্বের উচ্ছ্বাস, স্মৃতির ডাকে।’

সমাপ্তিতে সভাপতি নাজমুল হাসান ধন্যবাদ জানান সবাইকে। বিশেষ করে যাঁরা অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন—সাব্বির হোসেন, অনিক ভূষণ সাহা, অদ্বিত আল নাফিউ, সাদমান হোসেন, মোহাম্মদ ত্বাহা, রিজভী আমিন, রুবাইয়া রূপ, আবিদসহ সব স্বেচ্ছাসেবক বন্ধুদের। সার্টিফিকেট বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এদিনের আনন্দ উৎসব।

সহসাংগঠনিক সম্পাদক, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা