বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়

সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে প্রথম আলো বন্ধুসভার ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়
ছবি: দীপু মালাকার

‘এত মৃত্যু, এত আত্মত্যাগ, এত প্রতিজ্ঞা আমরা সহসা দেখি না। স্কুলের ছেলে আনাস চিঠি লিখে গেছে যে আমার বন্ধুরা যখন লড়াই করছে, আত্মদান দিচ্ছে, তখন যদি আমি বাড়িতে বসে থাকি, তাহলে এটা বেইমানি করা হবে। আমাকে যেতে দাও। সে মিছিলে গেল, গুলিবিদ্ধ হলো এবং শহীদ হলো। তার মা এখনো কাঁদছেন। আমরা হয়তো বাংলাদেশকে সুন্দর করব। আনাসের মা কিন্তু আর আনাসকে ফিরে পাবেন না। মুগ্ধর ভাই বা তাঁর পরিবার মুগ্ধর জন্য অপেক্ষা করতেই থাকবে। কত বড় ক্ষতি, এগুলো বলে শেষ করা যায় না।’

প্রথম আলো বন্ধুসভার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত হওয়া আনাস, মুগ্ধসহ সব শহীদ ও পঙ্গুত্ববরণ করা যোদ্ধাদের স্মরণ করে এভাবেই নিজের বক্তব্য শুরু করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘মানুষকে হত্যার পর আর ক্ষমতায় থাকার বৈধতা থাকে না। যখনই প্রথম গুলিটা হয়েছে, প্রথম একজন মানুষ মারা গেছে, তখনই আসলে আমাদের সাবেক সরকার বৈধতা হারিয়েছে। দেশের মানুষ সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে। আর আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক জয় দেখলাম। তবে লড়াইটা কেবল শুরু হয়েছে। এটা বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। যদি সত্যি সত্যি একটা বৈষম্যমুক্ত দেশ চাই, অন্তর্ভুক্তিমূলক একটা সমাজ চাই।’

বক্তব্যের শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত হওয়া আনাস, মুগ্ধসহ সব শহীদ ও পঙ্গুত্ববরণ করা যোদ্ধাদের স্মরণ করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক
ছবি: আব্দুল ইলা

১১ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করে প্রথম আলো বন্ধুসভা। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যাঁরা জীবন দিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন, তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। টিআইবির সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী শপথ আর নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে ‘তরুণোদয়ের নতুন আলোয়’ স্লোগানে এ অনুষ্ঠানে সারা দেশের অন্তত ৫৫টি বন্ধুসভার চার শতাধিক বন্ধু ও সুহৃদ অংশ নেন। পুরো অনুষ্ঠান সাজানো হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে।

আনিসুল হক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ একটা গাছ। এই গাছের কোনো পাতাই ছেঁড়া যাবে না। সেই পাতাগুলোর মধ্যে হিন্দু আছে, মুসলিম আছে, বৌদ্ধ আছে, খ্রিষ্টান আছে এবং আমাদের জনজাতিগুলো আছে। পাহাড়ি ও সমতলের নৃগোষ্ঠীরা আছে। সবাইকে নিয়ে আমাদেরকে চলতে হবে। এ কথাটা যেন আমরা ভুলে না যাই।’

বন্ধুসভার বন্ধুদের দুর্নীতিবিরোধী শপথ পাঠ করান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান
ছবি: দীপু মালাকার

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গৌরবময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুধু স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন ছিল না, ছিল বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সবার সমঅধিকারভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, এমন মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘যারা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে, যারা ধর্মের ভিত্তিতে দুটি মানুষকে আলাদা করে, যারা জেন্ডারের কারণে নারী-পুরুষকে আলাদা করে, যারা বাঙালি নাকি নৃতাত্ত্বিক বা অন্য সম্প্রদায়ের, তাদেরকে আলাদা করে; এ–জাতীয় ভেদপন্থী লোকগুলো এই সময়ে একটু বাড়াবাড়ি করছে। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ গঠনের অভীষ্ট অর্জনের অভূতপূর্ব সুযোগ পেয়েছি। সেই অভীষ্ট আমাদের অর্জন করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী চেতনা আমাদের জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন চলমান থাকবে। আশার কথা হচ্ছে, এই আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে আমরা সবাই সহযোদ্ধা।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা শোনান (বাঁ থেকে) আরিফুল ইসলাম আদিব, তাপসী দে প্রাপ্তি, নির্মাতা আশফাক নিপুন ও সায়মন চৌধুরী
ছবি: দীপু মালাকার

অনুষ্ঠানে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখ: ছাত্র-জনতা ও বন্ধুসভার সদস্যদের বক্তব্য’ শিরোনামে একটি বিশেষ আলোচনা পর্ব রাখা হয়। অংশ নেন নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আশফাক নিপুন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে কাজ করা লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম সদস্য ও বর্তমানে নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাপসী দে প্রাপ্তি ও বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক সায়মন চৌধুরী।

স্বপ্নের বাংলাদেশ আমরা কেমন চাই? এমন প্রশ্নের জবাবে আশফাক নিপুন বলেন, ‘আমাদের সমাজে দুর্নীতি এমনভাবে ঢুকে গেছে যে এমন অনেক কিছু আছে, যেগুলোকে আমরা দুর্নীতি হিসেবে চিন্তাই করছি না। অভূতপূর্ব আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের চিন্তা করতে যাচ্ছি, সেখানে আমাদের নিজেদের ভেতরের দুর্নীতিগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আমরা সব সময় চাই সিস্টেমটা আগে ঠিক হয়ে যাক, তারপর আমরা সবকিছু করব। কিন্তু সিস্টেমটা বানাবে কে? মানুষ। এই মানুষকে ঠিক করবে কে? সেটাও মানুষকেই করতে হবে।’

‘বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশের যে স্পিরিট আমাদের মধ্যে রয়েছে, সেটা যেন থাকে এবং এই স্পিরিট দিয়ে যাতে স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠন করতে পারি, সেই আশা করি’, যোগ করেন আশফাক নিপুন।

অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক ও নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ। বন্ধুসভার বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক
ছবি: দীপু মালাকার

তাপসী দে প্রাপ্তি বলেন, ‘এখানে যাঁরা তরুণ আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আমাদের গণ–অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজের জায়গা থেকে আমরা যে যেভাবে পেরেছি, সচেষ্ট ছিলাম। এ কারণেই আমরা আজ নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। গত ৫ আগস্টের আগে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে দেখেছি অভূতপূর্ব একতা; যখন মিছিলে যাচ্ছি, আমরা দেখছি না পাশের জন কোন দল করেন। আমরা কিন্তু সেটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। প্রত্যেকে জানতাম আমাদের শত্রু হচ্ছে স্বৈরাচার এবং স্বৈরাচারকে যেকোনোভাবেই হটাতে হবে।’

সবাইকে উদ্দেশ করে তাপসী দে বলেন, ‘গণ–অভ্যুত্থানের ফসল কিন্তু আমরা রাতারাতি পাব না। রাতারাতি একটি বিপ্লবী সরকারকে দিয়ে আমূলে দেশের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতার জায়গা থেকে সচেষ্ট থাকতে হবে। তাহলেই বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে, সেগুলো কিছুটা হলেও মোকাবিলা করতে পারব।’

ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার বন্ধুদের পরিবেশনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে মূকাভিনয় প্রদর্শনী
ছবি: আব্দুল ইলা

আন্দোলনের শুরু থেকে ৫ আগস্টের বিজয় পর্যন্ত গতিপ্রকৃতির বর্ণনা করেন নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদিব।
আন্দোলনে ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক সায়মন চৌধুরী। তিনি সেই অভিজ্ঞতা ও আন্দোলনের সম্পৃক্ততার গল্প শোনান।

বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক ও নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌর সঞ্চালনায়ও বারবার উঠে এসেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা ধরে রাখার কথা। তাঁরা বলেন, ‘তরুণেরা জেগেছে বলেই বাংলাদেশ জেগেছে। তরুণদের আলোতেই বাংলাদেশ নতুনভাবে গড়ে উঠবে।’

এ ছাড়া ছিল ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার বন্ধুদের পরিবেশনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটি মূকাভিনয় প্রদর্শনী। সাফিন উজ জামানের রচনা ও নির্দেশনায় এতে অভিনয় করেন শারমিন আরা তিশা, মেঘা খেতান, ওয়াসিমা তাসনিম, আশফাকুর রহমান ও খাদিজা জান্নাত।

অনুষ্ঠানে লাইফস্টাইল সহযোগী ছিল টুয়েলভ ক্লদিং, রিফ্রেশমেন্ট সহযোগী ইস্পাহানি, এন্টারটেইনমেন্ট সহযোগী চরকি ও নিউট্রিশন সহযোগী হিসেবে ছিল নিউট্রিপ্লাস।