‘মনকে বাধ্য করানো যাবে না’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক কর্মশালা শেষে অংশগ্রহণকারীরা
ছবি: বন্ধুসভা

বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত জায়গা। এখানে নিজেকে জানার যেমন সুযোগ রয়েছে, তেমনি নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ারও হাতিয়ার রয়েছে। মাদকাসক্ত, সহিংস কর্মকাণ্ডসহ যেকোনো ধরনের নেতিবাচক কাজ মানুষকে দ্রুত অধিগ্রহণ করে। এ কারণে সবকিছু প্রত্যাশা অনুযায়ী না–ও হতে পারে। তাই বলে সবকিছু শেষ—এসব ভেবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বেঁচে থাকার চাহিদা রাখতে হবে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না।

৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ইউনিমেড ইউনিহেলথের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং প্রথম আলো ট্রাস্ট ও বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতায় এর আয়োজন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা।

সকাল ১০টায় অতিথিদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কর্মশালা শুরু হয়। সেশন পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহীনুর রহমান ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. পঞ্চানন আচার্য। এ ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তরুণদের ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে কথা বলেন চবি বন্ধুসভার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার আহসান। তাঁরা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন। কর্মশালা শেষে অংশগ্রহণকারী ৮০ শিক্ষার্থীকে সনদ দেওয়া হয়।

‘পাঁচ ঘণ্টা শুয়ে থাকার পরেও ঘুম আসে না, এর সমাধান কী?’, ‘মনোযোগ দিয়ে পড়লেও মনে থাকে না, অথচ অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয় মনে থাকে, এর কারণ কী?’, বিষণ্নতা কাটানোর জন্য ফেসবুকে রিলস দেখছি। কিন্তু রিলস দেখার পর আরও বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছি, এর কারণ কী?’, ‘কোনো কারণ ছাড়া অস্বস্তি লাগে, এটা কি মানসিক অসুস্থতা?’—এমন আরও জটিল প্রশ্নের উত্তর উঠে আসে বন্ধুসভার মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক কর্মশালায়।

উদ্বোধনী পর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার সভাপতি রাহী হাসান চৌধুরীর স্বাগত বক্তব্যের পর অতিথির বক্তব্য দেন জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের সভাপতি প্রফেসর নাজনীন নাহার ইসলাম, মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুন নাহার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তাসনিম মুশাররাত প্রমুখ।

তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে শাহরিয়ার আহসান বলেন, তরুণেরা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি থেকে শুরু করে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা পর্যন্ত ভূমিকা পালন করে। একুশ শতকের যুগ, কর্মদক্ষতার যুগ; আর কর্মদক্ষতা নির্ভর করে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরিবারকে বাচ্চাদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। তরুণেরা মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস গঠন, মেডিটেশন, সুষম দিনলিপি, শারীরিক-মানসিক ব্যায়াম মেনে চলতে পারে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকার আমাদের দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতনতাই পারে মানসিকভাবে সুস্থ একটি জাতি সৃষ্টি করতে পারে।

আলোচক, আমন্ত্রিত অতিথি ও অংশগ্রহণকারীরা
ছবি: বন্ধুসভা

কর্মশালায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সহযোগী অধ্যাপক মো. শাহীনুর রহমান বলেন, ‘সারা বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যায় মারা যাচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছরে এ সংখ্যা ৭ লাখ ৩ হাজার। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশই বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশের। অধিকাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বেশি আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। পত্রপত্রিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত বছর ৫৮৫ জন শিক্ষার্থী আর চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত ৩৬১ জন আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঁচলের হিসাবে আত্মহত্যা করা ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আবার আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১৯ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার কথা ভাবেন, ১৬ শতাংশ পরিকল্পনা করেন, ৯ শতাংশ চেষ্টা করেন আর ৩ শতাংশ চেষ্টার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।’

মনোবিজ্ঞান বিভাগের এ শিক্ষক বলেন, ‘আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, এমন অনেক মানুষ চারপাশে আমরা দেখি। তাঁরা সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। কখনো আত্মহত্যার হুমকি দেন, মাদকাসক্ত হন, অহেতুক অসদাচরণ করেন, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাঁদেরকে ইতিবাচক ইমোশন যেমন আনন্দ, ভালোবাসা, গর্ব, সাহায্য, উপভোগ্য কাজ করাতে হবে। এ ছাড়া সম্পর্ক সুন্দর রাখা, জীবনের মানে খুঁজে বের করা, প্রকৃতির সঙ্গে এনগেজ করতে হবে।’

কর্মশালার একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সহকারী অধ্যাপক ডা. পঞ্চানন আচার্য। এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন, ‘ঘুমানোর পরিবেশ আছে, কিন্তু পাঁচ-ছয় ঘণ্টা শুয়ে থাকার পরেও ঘুম আসছে না। এর কারণ কী?’ এর জবাবে পঞ্চানন আচার্য বলেন, ‘ঘুমের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করতে হবে। ধরা যাক, আপনি রাত ১১টায় ঘুমিয়ে সকাল সাতটায় উঠবেন। এ ক্ষেত্রে ১১টায় ঘুম না এলেও শুয়ে পড়তে হবে। আর ঘুম পূর্ণ না হলেও সাতটায় উঠতে হবে। সারা দিন আর ঘুমানো যাবে না। এমনটি হলে শরীরে ঘুমের জন্য একধরনের ঘড়ি ঠিক হবে। এরপরও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে ঘুমানোর দুই ঘণ্টা আগে থেকে ফোন ল্যাপটপ চালানো বাদ দিতে হবে। শুয়ে পড়ার ২০ মিনিটের মধ্যে ঘুম না হলে উঠে হাঁটতে হবে, অথবা হালকা মেজাজের বই পড়তে হবে। এভাবে ঘুম না আসা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিছানায় অন্য কোনো কাজ করা যাবে না। বিছানা শুধু ঘুমের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

আরেক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন, ‘মনোযোগ দিয়ে পড়লেও মনে থাকে না, এর কারণ কী?’ এর জবাবে পঞ্চানন আচার্য বলেন, ‘এর কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের মনকে বাধ্য করি। মনকে বাধ্য করানো যাবে না। মনে রাখতেই হবে এমন প্রত্যাশা রাখা যাবে না। পড়তে পড়তেই শিখব এমনভাবে পড়তে হবে। সময় দিতে হবে। বাড়তি চাপ নেওয়া যাবে না।’

আরেক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন, ‘বিষণ্নতা কাটানোর জন্য ফেসবুকে রিলস দেখি। কিন্তু দেখার পর আবার বিষণ্ন হয়ে যাই, এর কারণ কী?’ জবাবে মনোরোগবিদ্যা বিভাগের এ শিক্ষক বলেন, ‘অনেক সময় আমরা বিষণ্নতার কারণকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অন্য কাজে মনোযোগ দিই। তাই সমাধান হয় না। রাস্তায় কুকুর কামড়াবে এ ভয়ে যদি রাস্তা পার না হন, তাহলে রাত পার হলেও আপনার বাড়িতে যাওয়া হবে না। তাই সমস্যাকে না এড়িয়ে এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে। তাহলেই আপনার গন্তব্যে যাওয়া সম্ভব হবে।’

কর্মশালাটি সঞ্চালনা করেন বন্ধুসভার কার্যনির্বাহী সদস্য ফারিয়া আক্তার। সমাপনী বক্তব্যে ও সনদ বিতরণ পর্বে সাধারণ সম্পাদক আদিত্য গোস্বামী বলেন, ‘আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছি, তাদের অধিকাংশই পরিবার–পরিজন থেকে অনেক দূরে থাকছি। তাই কোনো সহপাঠীকে বিষণ্ন দেখলে তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আলোচনা ছাড়া মানসিক সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।’