আজ সৃষ্টি–সুখের উল্লাসে

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বন্ধুরা
ছবি: আনাস খান

নজরুল দ্রোহের কবি। অন্যায় আর অবিচার দেখলে তিনি হয়ে উঠতেন বিদ্রোহী ও বিপ্লবী। কবিতা ও গান লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এককথায় বিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যে তিনি ছিলেন আরেক মাইলফলক এবং অমূল্য সম্পদ। বিদ্রোহী ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে ভৈরব বন্ধুসভা আয়োজন করে ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে, গান-কথা-কবিতায় নজরুল স্মরণ’।
২৬ মে রাত ৮টা প্রথম আলোর ভৈরব অফিসে একঝাঁক তারুণ্যের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে—
‘দূর দ্বীপবাসিনী,
চিনি তোমারে চিনি
দারুচিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো’
গানটি গাইছিলেন বন্ধু জান্নাতুল প্রীতি। এ গানের মাধ্যমেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনের আয়োজনের সূচনা হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি। সারা জীবন তিনি সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কলম ধরেছেন। তিনি নির্ভীক চিত্তে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে থেকেছেন আপসহীন। লোভ-খ্যাতির মোহের কাছে মাথা নত করেননি। অন্যদিকে তিনি মানুষের হৃদয়ের কোমল অনুভূতির প্রতিও সমান আবেগে সাড়া দিয়েছেন। অজস্র গানে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীতভুবন। প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা গজল। তাঁর গানের সংখ্যা চার হাজার বলা হলেও গবেষণায় দেখা যায়, তিনি গান লিখেছিলেন আট হাজারের মতো, যার অধিকাংশই সংরক্ষণ করা যায়নি। কথাগুলো বলছিলেন সাধারণ সম্পাদক রিফাত হোসাইন ও সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন। তাঁরা দুজন আয়োজনটির সঞ্চালক ছিলেন।

নজরুলসংগীত এখনো বেশ জনপ্রিয়। গানের প্রতিটি লাইন যেমন হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তেমনি নতুন কিছু ভাবতেও শেখায়। দুর্যোগ ও ত্রাণ সম্পাদক মোশারফ রাব্বি শোনান—‘মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর’, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’ এই দুটি গান। জান্নাতুল প্রীতি আরও শোনান ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ গানটি। এখানে কবি আসলে রূপক অর্থে সুফি দর্শন তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের কথায় অন্তর্নিহিত এ গানের বক্তব্য।

ভৈরবে গান-কথা-কবিতায় নজরুল স্মরণ
ছবি: আনাস খান

মানবজীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে প্রেমের বিচরণ, প্রেম ভাবতে শেখায়, হাসতে শেখায়, কাঁদতেও শেখায়। প্রেমের অনুভূতিগুলো কবির কাব্যিক অবয়বে নতুন রূপে প্রকাশিত হয়। বন্ধু মেধা আবৃত্তি করেন ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি। কবি তাঁর বিরহ-ব্যাকুলতা, শোকার্ত হৃদয়ের যন্ত্রণাকে ‘চাঁদ’, ‘সাগর’, ‘সুর’, ‘বীণা’ প্রভৃতির চিত্রকল্প প্রয়োগ করেছেন এই কবিতায়। কার্যনির্বাহী সদস্য সেলিম রেজা আবৃত্তি করেন কান্ডারি হুঁশিয়ার।

গান-কবিতার ফাঁকে চলে নজরুলের জীবনকর্ম নিয়ে আলোচনা ও বন্ধুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার ভিডিও চিত্র প্রদর্শন। ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ গানে সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন ও সহসভাপতি সানজিদা সিদ্দিকার পরিবেশনাটি দেখানো হয়। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে লাইভে যুক্ত হন স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক তাবাসসুম কায়সার। তিনি শোনান ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ’ গানটি। ‘আমার গানের মালা আমি করব কারে দান’ গানটি শোনান নতুন বন্ধু নুসরাত জামান।

উপদেষ্টা সুমন মোল্লা বলেন, ‘নজরুলকে আমাদের করে পাওয়া ও জাতীয় কবি করার পেছনে যাঁর ভূমিকা ছিল, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধু। নজরুলকে দেশে আনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। নজরুলকে নিয়ে বিমান যখন ঢাকায় আসে, তখন পুরো বিমানবন্দর এলাকায় এতটুকু জায়গা ফাঁকা ছিল না প্রিয় কবিকে কাছ থেকে দেখতেও অভ্যর্থনা জানাতে। নজরুল আগ্রহের জায়গায় ছিলেন পুরো বাঙালির কাছে। কবির প্রতি মানুষের আগ্রহ, ভালোবাসার ফলেই আমরা সেদিন ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।’

নজরুল আলোচনায় আরও যুক্ত হন উপদেষ্টা আলাল উদ্দিন, সহসাংগঠনিক সম্পাদক এরফান হোসেন, দপ্তর সম্পাদক আনাস খান, বন্ধু শাওন, জিহাদ, অনুপম, সানজিদা। কার্যনির্বাহী সদস্য প্রিয়াংকা বলেন, ‘ছোটবেলায় “আমি হব সকাল বেলার পাখি” কবিতা থেকে কবির সঙ্গে পরিচয়। তারপর ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্রের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে আরও ধারণা পাই। আমাদের কাছে ঈদের পূর্ণতা মানেই কাজী নজরুলের “ও মন রমজানের ওই রোযার শেষে” গানটি। ছোটবেলায় এই গান যখন সন্ধ্যায় টিভিতে বেজে উঠত, তখন বুঝতাম, আগামীকাল ঈদ হবে। ভৈরব বন্ধুসভার উদ্যোগে গানটির একটি বিশেষ ভিডিও চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল ২০২১ সালে, যেখানে ৭২ জন বন্ধু অংশ নেন। ভিডিওটি বেশ দর্শকনন্দিত হয়, যার ভিউ এখন ৩৫ হাজারের বেশি।’

উপদেষ্টা সুমাইয়া হামিদ জানান, ভৈরব বন্ধুসভার পাঠচক্রে নজরুল চর্চা করা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, নজরুলজয়ন্তীসহ নানা সাহিত্যনির্ভর আয়োজনে ভৈরব বন্ধুসভা সক্রিয়।

আয়োজনটি ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকেও লাইভ সম্প্রচার করা হয়
ছবি: আনাস খান

সভাপতি নাহিদ হোসাইন বলেন, ‘বাংলা সংগীতজগতের কোনো গীতিকার এখনো নজরুলসংগীত রচনার রেকর্ড ভাঙতে পারেননি। নজরুল নিজেই বলেছিলেন, “আমার জীবনে প্রথম সুন্দর আসে ছোটগল্প হয়ে, তারপর কবিতা, নাটক, উপন্যাস হয়ে বহুবার ধরা দিয়েছে। অবশেষে সংগীত হয়ে আমার মাঝে বিরাজ করেছে সেই সুন্দর।” নজরুলের হাত ধরেই বাংলা সংগীতে প্রথম গজল, শ্যামা সংগীত, ইসলামী সংগীতের সৃষ্টি। এ ছাড়া বাংলা সংগীতে ২০টির বেশি রাগের জন্ম নজরুলের হাতে। মধ্যপ্রাচ্যের সুর ও আবহ তৈরি করে বাংলা সংগীতকে তিনি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। অজস্র গানে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলার সংগীতভুবন। সামনের দিনগুলোতে আমরা জীবনানন্দ দাশ, লালন, সুকান্তসহ বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের নিয়ে আয়োজন করব।’

‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয়
চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায়
বাতায়ন খুলে দিয়ো’
গানটি গেয়ে শোনান মোশারফ রাব্বি, সঙ্গে যোগ দেন সমবেত সব বন্ধু। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি হয় নজরুল স্মরণে আজ ‘সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ আয়োজনটির। আয়োজনটি ভৈরব বন্ধুসভার ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ সম্প্রচার করা হয়।

সভাপতি, ভৈরব বন্ধুসভা