লালমনিরহাটে যুক্তির চর্চায় অদম্য তারুণ্য

দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে লালমনিরহাট বন্ধুসভার দিনব্যাপী বিতর্ক ও উপস্থাপনাবিষয়ক কর্মশালা
ছবি: বন্ধুসভা

দেশের সর্ব উত্তরের জনপদ লালমনিরহাট। ভারতের সীমান্তঘেঁষা এই জনপদ বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে মাত্র ২২১ কিলোমিটার দক্ষিণে। তাই শীত যেন এখানে একটু আগেই জেঁকে বসে! মাঝ অক্টোবরের সাতসকালের সূর্যতাপও খানিকটা স্লান হয় মৃদু হিমেল বাতাসের আবেশে।

১৫ অক্টোবর এমন এক সকালে জেলার ফাকল পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা রঙের পোশাকে এক দল শিক্ষার্থীর ভিড়। তখনো স্কুলের মূল ফটক খোলা হয়নি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের উৎসাহে কোনো কমতি নেই। বহুদিন পর যে এ শহরে আয়োজন হচ্ছে বিতর্ক ও উপস্থাপনাবিষয়ক কর্মশালা! লালমনিরহাট বন্ধুসভার আয়োজনে এ কর্মশালায় আগে থেকেই নিবন্ধন করে এসেছে তারা। শহরের সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কুড়িগ্রামের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আসে কর্মশালায় অংশ নিতে। দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর মিলনায়তনে সকাল সাড়ে নয়টায় শুরু হয় মূল আয়োজন। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বেশ কিছু অভিভাবককেও দেখা যায়। আর বন্ধুসভার বন্ধুরা তো ছিলেনই!

আগত শিক্ষার্থীদের নিবন্ধনে সহায়তা করে স্বাগত জানান লালমনিরহাট বন্ধুসভার সহসাংগঠনিক সম্পাদক সাব্বির ইসলাম, প্রচার সম্পাদক আবু সায়েদ, পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক মৌনিতা রহমান, বইমেলা সম্পাদক মিতু আক্তার, দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক রনি কোরাইশি, সদস্য খাদিজা আক্তার ও জিনিয়া জাফরিন। বন্ধুসভার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারাহ নাজের সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বন্ধুসভার সভাপতি রফিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন বন্ধুসভার উপদেষ্টা এবং প্রথম আলোর প্রতিনিধি আবদুর রব। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ফাকল পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরউন নবী, বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখারুল ইসলামসহ অন্যরা।

এরপর বিতর্কের বিভিন্ন ধরন, খুঁটিনাটি বিষয় এবং যুক্তি গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেট অর্গানাইজেশনের সাবেক সভাপতি মাসুম রেজা। এ সময় তিনি বাস্তব জীবনে বিতর্কের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে মানসিক বিকাশের নানা দিক বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করেন।

এরপর বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক বিতর্ক ও উপস্থাপনার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন।

তিনি বলেন, ‘বিতর্ক ব্যক্তির মেধার বিকাশ ঘটায়, নেতৃত্বগুণসম্পন্ন করে এবং বিতর্কের মধ্য দিয়েই মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে। সবাই বিতর্কের চর্চা করলে সমাজে অসহিষ্ণুতা কমে আসবে, মানুষ পরমতসহিষ্ণু হবে। বিতর্ক মাদক, ইভ টিজিংয়ের মতো অন্যায় থেকে বিরত রাখে। কারণ, যারা যুক্তিবাদী, তারা মাদক নেয় না, আর যারা মাদক গ্রহণ করে, তারা কোনোভাবেই যুক্তিবাদী হয় না।’ এ সময় তিনি উপস্থিত শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিকভাবে মাদকবিরোধী শপথ পাঠ করান। শিক্ষার্থীরাও দুই হাত তুলে মাদক না নেওয়ার এবং মাদকাসক্তকে বন্ধু না বানানোর শপথ নেয়। এক সুরে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে, ‘যেই মুখে মা, সেই মুখে মাদক না; আমরা যুক্তিবাদী, আমরা মাদক নিই না।’

প্রশিক্ষণপর্ব শেষে আয়োজন করা হয় প্রদর্শনী বিতর্ক। এতে ‘মাদকাসক্তি থেকে যুবসমাজকে দূরে রাখতে প্রশাসনের চেয়ে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য’ এ বিষয়ের পক্ষে বিতর্ক করেন ফাকল পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন কুড়িগ্রাম পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রদর্শনী বিতর্কের মডারেটর ছিলেন লালমনিরহাট সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ও প্রভাষক, সাবেক বিতার্কিক উম্মে তাজ।

সবশেষে অংশগ্রহণকারীদের সনদ প্রদান করেন অতিথিরা। এরপর দলীয় ছবি তোলার মধ্য দিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী এ প্রাণোচ্ছল অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। সমাপনী অধিবেশনে উপস্থিত অভিভাবকদের পক্ষে অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন আদিতমারী কে বি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং লালমনিরহাট সনাকের সহসভাপতি আবু হাসনাত। বন্ধুসভার আয়োজনে এমন চমৎকার কর্মশালার উদ্যোগ নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।

বিতর্ক ও উপস্থাপনাবিষয়ক এ কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে লালমনিরহাটের ফাকল পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কালেক্টরেট কলেজিয়েট স্কুল, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সরকারি কলেজ ও সরকারি মজিদা খাতুন মহিলা কলেজ এবং কুড়িগ্রাম পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। নিবন্ধন পর্ব থেকে শুরু করে কর্মশালার শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্ক সংগঠন গঠন ও চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা হয়।