গাহি সাম্যের গান
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিভিন্ন অঙ্গনের নারীদের সাহস, বিজয় ও সাফল্যের অভিজ্ঞতা শুনতে বিশেষ অনুষ্ঠান করেছে বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদ। অনুষ্ঠানে জাতীয় নারী বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। দেশজুড়ে অন্যান্য বন্ধুসভাও নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকারবিষয়ক নানা আয়োজন করেছে। ছবি তুলেছেন আশরাফুল আলম ও শেখ কাব্য।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল নারীদের। এ সময় দেশ এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়—মেয়েদের সঙ্গে মায়েরাও রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা রাজপথে ছিলেন বলেই অভ্যুত্থান এত দ্রুত সফল হয়েছে। এই নারীরা এখন কেবল নারী হিসেবেই পরিচিত হতে চান না, তাঁরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজ যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে চান। জেন্ডারের ভিত্তিতে নয়, বরং সাম্যতা চান মানুষ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো বন্ধুসভার অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন অতিথিরা। ‘গাহি সাম্যের গান’ শিরোনামে বিভিন্ন অঙ্গনের নারীদের সাহস, বিজয় ও সাফল্যের অভিজ্ঞতা শুনতে ৯ মার্চ বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সভাকক্ষে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ। অনুষ্ঠানে নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় নারী বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতা ২০২৫-এর ফলাফল ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সভায় ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বন্ধুসভার বন্ধুরা অংশগ্রহণ করেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা ও বর্তমানে করণীয় বিষয়ে কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের আগপর্যন্ত আমি কেবল রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন নারী ছিলাম। কখনো চিন্তা করিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নেব। এই গণ–অভ্যুত্থান অনেকগুলো জং-ধরা রাস্তা খুলে দিয়েছে।’
তাজনূভা জাবীন আরও বলেন, ‘এখন মেয়েরা অনেক যোগ্য, আগের চেয়ে বেশি সচেতন। এ কারণেই জুলাইয়ে তারা রাজপথে নেমে আসতে পেরেছিল। প্রত্যেক মেয়েকে আহ্বান জানাব, তোমরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবে। কারণ, দেশটা ঠিক ততটুকু তোমার, যতটুকু একজন পুরুষের। একটা রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কখনোই প্রতিষ্ঠিত হবে না, যদি নারীরা নেতৃত্বে না আসে এবং এটার জন্য নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে।’
রেডিয়েন্ট স্মাইল অ্যাস্থেটিক লাউঞ্জের সিইও ডা. লায়লা নাজনীন বলেন, ‘দাঁতের চিকিৎসা পেশায় আমার যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না। শুরুর দিকে অনেকে বলত আমি পারব না। তবে এটিকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। বর্তমানে অনেক নারী আমার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এটা গর্বের। আমরা নারীরাই পারি নারীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে।’
রেজুভা ওয়েলনেসের সিইও ডা. তৌহিদা রহমান ইরিন বলেন, ‘সাফল্য পেতে হলে কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যখন যে পরিবেশে থাকব, সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। আবার সাফল্য মানেই কিন্তু কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়া নয়; বরং আমরা যেখানে আছি, সেটিকে কমফোর্ট জোন বানিয়ে ফেলা।’
এর আগে বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক সাইমুম মৌসুমী বৃষ্টির সঞ্চালনায় শুরুতেই একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান রয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আম্বারিন চৌধুরী। হোম ম্যানেজমেন্টে নারীরা এগিয়ে থাকলেও হোটেল ম্যানেজমেন্টে কেন পিছিয়ে—এ বিষয়ে কথা বলেন আমারি ঢাকার সিনিয়র এইচআর এক্সিকিউটিভ নাদিয়া রিমু। দেশে নারী ও শিশুর প্রতি চলমান সহিংসতা নিয়ে কথা বলেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি ও সাইকোথেরাপিস্ট মাহমুদা মুহসিনা বুশরা।
চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন স্টার সিনপ্লেক্সের হেড অব এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন লায়লা নাজনীন। তিনি বলেন, ‘চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা এখন অনেক এগোনো। আগে যেমন ছিল—পুরুষেরা ভালো করত, নারীরা ভালো করত না। এখন এটা পরিবর্তন হয়েছে। কিছু কিছু জায়গা থাকে, ওই অবস্থানে নারী লাগবে। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠানেই নারীরা সবচেয়ে ভালো কাজ করছে।’
বন্ধুসভা একটা সাম্যের প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, ‘নারী-পুরুষ মিলেই বন্ধুসভা। নেতৃত্বেও তারা মিলেমিশে কাজ করে। আর প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সারা বছরই চেষ্টা করি মেয়েদের দিকগুলো যতটা সম্ভব যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার। আমরা নারীদের অনুপ্রেরণার গল্পগুলো সামনে আনি। এ কারণে আনি, আমরা জানি, প্রতিটি সাফল্যের পেছনে একটা লড়াই–সংগ্রাম থাকে, না–বলা কান্না থাকে। এগুলো ছাপিয়ে সামনে কীভাবে যেতে হবে, এ গল্পগুলো যদি বারবার বলা হয়, তাহলে প্রতিদিনের যে লড়াইগুলো, সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য তা শক্তি হিসেবে কাজ করে।’
জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশনের সভাপতি মির্জা সাকি বলেন, ‘নারী হিসেবে সাফল্যগাথা নারী দিবস এলেই বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়। নারী দিবস এলেই নারী হিসেবে তার সাফল্য, উৎকর্ষ, দক্ষতা নিয়ে কথা বলাটা মনে হয় একজন মানুষ হিসেবে বেশ অবমাননাকর। একজন মানুষ হিসেবে আমার যোগ্যতা কী, বুদ্ধিমত্তা কতটুকু, সততা কতটা—এসব জেন্ডারের ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত নয়।’
নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক সাম্য বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি এবং প্রথম আলো বন্ধুসভা এ বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চায়।
নারীদের অনুষ্ঠান বলে এদিন কেবল নারীরাই উপস্থিত ছিলেন না, বরং বন্ধুসভার অনেক পুরুষ বন্ধুও এসেছিলেন। নারী-পুরুষের সমতা নিয়ে বক্তব্য দেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী ফিরোজ, রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক ও অর্থ সম্পাদক নূরে আলম। তাঁরা বলেন, এ সমাজকে গড়ার জন্য সবারই ভূমিকা আছে। নারী ও পুরুষ মিলেই একটি সমাজ গড়ে ওঠে। তবে নারীরা বেশি দায়িত্ববান। তাঁদের সাহস জোগানো ও প্রকৃত সুযোগ নিশ্চিত করলেই তাঁরা আরও এগিয়ে যাবেন।
বন্ধুসভার বন্ধুদের উদ্দেশে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘আমার মনে হয়, আপনারা এক ধাপ এগিয়ে গেছেন; নারীবাদের চেয়েও মানবিকতাবাদ, মনুষ৵ত্ববাদ, মানবতাবাদ নিয়ে কথা বলছেন। এটাই আমাদের চাওয়া। আমরা মানুষ হিসেবে সবাই মিলে একটি সুন্দর–সাম্যের পৃথিবী চাই।’
নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার জন্য সামাজিক সাম্য বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি এবং প্রথম আলো বন্ধুসভা এ বার্তাই ছড়িয়ে দিতে চায় জানিয়ে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘পুরুষ তার ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য নারীকে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে সব সময় কোমল অবয়বে নারীকে দেখতে চায়। অথচ মানুষমাত্রই কোমল, মায়াময় হওয়ার কথা। পুরুষমাত্রই শক্তিমান এবং নারীমাত্রই কোমল—এ ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। তাহলেই নারী-পুরুষের বিভাজন থেকে বের হয়ে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারব।’
দেশজুড়ে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে বন্ধুসভার প্রত্যয়
‘রমজানে নারী স্বাস্থ্য’ শিরোনামে স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক আলোচনা সভা ও বিনা মূল্যে ওষুধ বিতরণ করে জামালপুর বন্ধুসভা। ৮ মার্চ সদর উপজেলার পূর্ব বামুনপাড়া গ্রামের সুহৃদ প্রাক্–প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন গ্রামটির অর্ধশত নারী।
নারীদের সাধারণ স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে আলোচনা করেন মেডিকেল শিক্ষার্থী ও জামালপুর বন্ধুসভার সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ইসলাম খান এবং স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক ফারজানা আক্তার। পবিত্র রমজানে নারীস্বাস্থ্য ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়ে পরামর্শ দেন সহসভাপতি ডা. কানিজ ফাতেমা।
‘সংগ্রামী নারীদের সংগ্রামের কথা’ শিরোনামে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী কৃতী নারী খেলোয়াড়দের সম্মাননা প্রদান করে ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভা। এ সময় তাঁদের জীবনের সংগ্রামের কথা, সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও অর্জনের গল্প শোনেন বন্ধুরা।
অনলাইন প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও আলোচনা সভা করে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা। প্ল্যাকার্ডে নারীদের উদ্দেশে বিভিন্ন স্লোগান ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য লেখা হয়।
অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ভৈরব বন্ধুসভা। অংশ নেন সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষার্থী।
আলোচনা সভা ও পাঠচক্র করেছে খুলনা, দিনাজপুর ও ঝিনাইদহ বন্ধুসভা। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নোয়াখালী বন্ধুসভা।