‘আমি বলি, “মায়ের পেটে ঝিয়ের জন্ম”—এই ধাঁধাঁর উত্তর কী? অনেকে বলে ডিম আর মুরগি। মায়ের পেটে ঝিয়ের জন্ম, আবার ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম। আমি বলি, এটার একটাই উত্তর। সেটা হচ্ছে প্রথম আলো বন্ধুসভা। কারণ, প্রথম আলো ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর বের হলেও ওই বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বরেও বন্ধুসভা ছিল। মনে আছে, আমি, মতি ভাই, আব্দুন নূর তুষার—আমরা বিভিন্ন শহরে যেতাম, সেখানে বন্ধুসভা আমাদের অভ্যর্থনা জানাত। আমরা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করে বলতাম, একটা নতুন কাগজ বের হচ্ছে—“প্রথম আলো”।’
বন্ধুসভার ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্যাপন অনুষ্ঠানে বন্ধুসভা নিয়ে এভাবেই স্মৃতিকাতর হয়ে যান প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক। বন্ধুসভার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম আলো বন্ধুসভা দারুণ দারুণ কাজ করে। এর মধ্যে গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ, জিপিএ-৫ সংবর্ধনাসহ প্রথম আলোর সব আয়োজন করে তারা। বন্ধুরা বন্যার্তদের সাহায্য করে, সাইক্লোন–দুর্গতদের সাহায্য করে। বিশেষ করে ফেনীসহ ওই অঞ্চলের বন্যায় বন্ধুসভা দারুণ কাজ করেছে। এখন দেখছি যে সারা বাংলাদেশে আমাদের তরুণেরা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, ক্যারিয়ারটা সুন্দর করতে পারে, এ জন্য অনুষ্ঠান করছে বন্ধুসভা।’
আনিসুল হক বলেন, ‘প্রথম আলোর একটাই চাওয়া, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের জয়। বাংলাদেশের জয় কারা আনবে? বাংলাদেশের তরুণেরা। সেটার প্রমাণ আমরা বারবার দেখছি। ২০২৪-এ আমরা দেখেছি তরুণেরা সারা পৃথিবীর মতোই বাংলাদেশেও নতুন পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আমাদের সব কটি পরিবর্তনের সূচনাই তরুণেরা করেছে। আমরা এগিয়ে যাব। বাংলাদেশের জয় হবেই। সেটা বাংলাদেশের তরুণেরা করবে। বন্ধুসভা সেই জয়ে অবশ্যই অবদান রাখবে।’
‘সত্য সাহসে অপরাজেয় বন্ধুত্ব’ স্লোগানে ১৩ নভেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় আর্কাইভস মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আলো বন্ধুসভার ২৭তম বর্ষপূর্তির আনন্দ অনুষ্ঠান। এতে জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ, ঢাকা মহানগর ও ঢাকার ২৩টিসহ ‘একটি ভালো কাজ’-এ সেরা দশের পুরস্কার পাওয়া বন্ধুসভার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর বন্ধুসভার থিম সং ‘ও বন্ধু, সুন্দর একটি বাংলাদেশ আমরা গড়ব সবাই’-এর সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন একদল বন্ধু। অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল সংগীত, নৃত্য, ভালো কাজের জন্য সেরা বন্ধুসভার পুরস্কার বিতরণী ও আলোচনা দিয়ে। উপস্থিত বন্ধুদের পরস্পরের কুশল বিনিময়, আলাপচারিতায় অন্তরঙ্গ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে ছিল আলোচনা ও বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বন্ধুদের যে শক্তি, বন্ধুদের যে সাহস, তা আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। কারণ, আপনারা বর্তমান প্রজন্ম। আগামীতে অনেক কিছু দেওয়ার আছে, অনেক কিছু করার আছে। আমি বলি বন্ধুত্ব সাহস, বন্ধুত্ব শক্তি, বন্ধুত্ব রং, বন্ধুত্ব আলো, বন্ধুত্বে থাকে পথচলার সাহস আর আলো। এই আলো কিন্তু খুব দরকার। এই আলোয় আমরা আলোকিত হই, আমাকে আপনারা আলোকিত করেন, আমি হয়তো পাশের বন্ধুটিকে আলোকিত করি, সেই বন্ধু আবার আরেকজনকে আলোকিত করেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, যখন আমরা আলো ছড়াব, সেই আলো ছড়ানোর আগে নিজেকে আলোকিত করাটা খুব দরকার। সেই জায়গায় এই বন্ধুসভা হচ্ছে একটা প্রশিক্ষণভূমি কিংবা বন্ধুত্বের জাগরণক্ষেত্র। এখান থেকে আমরা শিখি, নিজেকে তৈরি করি।’
‘আমরা চাই, আমরা একসঙ্গে আরও অনেক দূর পথ চলব, সত্য সাহসের পথে সামনে এগিয়ে যাব এবং নিজেদের শক্তি দিয়ে সবকিছু জয় করব,’ যোগ করেন মৌসুমী মৌ।
‘আমরা এগিয়ে যাব। বাংলাদেশের জয় হবেই। সেটা বাংলাদেশের তরুণেরা করবে। বন্ধুসভা সেই জয়ে অবশ্যই অবদান রাখবে।’প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক
বন্ধুসভা সারা বছর ধরে অনেক রকম কাজ করে থাকে। সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক এসব কাজের ক্ষেত্রে বন্ধুরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করেন, নিজেরাই কর্মসূচি নেন। অনেক সময় জাতীয় কমিটির কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থেকেও কাজ করেন। গত এক বছরের কাজের বিবরণী তুলে ধরেন জাতীয় পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক। এ সময় মঞ্চের নেপথ্যের ডিজিটাল পর্দায় এসব কার্যক্রমের পরিচিতি তুলে ধরা হয়। ফরহাদ হোসেন মল্লিক বলেন, ‘২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় পর্ষদের বর্তমান কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছি। আর মূল কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় বন্ধুসভাগুলো।’
বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘বন্ধুসভার বন্ধুরা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আপনারা না থাকলে বন্ধুসভা নেই।’ তিনি বলেন, ‘সারা দেশের বন্ধুরা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে, শুধু বন্ধুসভার সুনাম বৃদ্ধির জন্য, প্রথম আলোর সুনাম বৃদ্ধির জন্য, নিজেদের আত্ম–উন্নয়নের জন্য, বাংলাদেশকে আরেকটু ভালো করার জন্য কাজ করছেন। বন্ধুরা কাজ করেন বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের জন্য। আর সেই স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার হিসেবে পুরো দেশে লক্ষাধিক বন্ধুকে গত ২৭ বছরে আমরা এক করতে পেরেছি।’
প্রথম আলোর চিফ ডিজিটাল বিজনেস অফিসার জাবেদ সুলতান বন্ধুদের পরামর্শ দেন ফেসবুকে কী লেখা যাবে, কী লেখা যাবে না—এ বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘ধরেন, আপনার সামনে চারজন মানুষ আছেন। এর মধ্যে একজন পরিবারের, একজন বন্ধু, একজন শিক্ষক, বস বা ওই শ্রেণির কেউ এবং একজন প্রতিবেশী কেউ। তাঁদের সামনে যে কথা বলা যাবে না, সে কথা ফেসবুকেও লেখার দরকার নেই। আর যেটা লিখব সেটা হচ্ছে, আপনার ব্যক্তিত্ব, ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার বাইরে বাস্তবে আপনি যেমন সেটাই যেন ফেসবুকে উপস্থাপিত হয়। কোনো ভুল যোগাযোগ যেন না হয়, এমন কিছু।’
জাবেদ সুলতানের বক্তব্যে উঠে আসে মফস্সল থেকে উঠে আসা ও বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গল্প। জাবেদ সুলতান বলেন, ‘আমি আমার হয়ে ওঠার পেছনে প্রথম আলো ও বন্ধুসভার বড় অবদান।’
বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের উপদেষ্টা অধ্যাপক মুমিত আর রশিদ ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মহসিন মাখমালবাফের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘তোমরা যদি এক বছর পরে তোমার ঘরে ফসল তুলতে চাও, তার সুফল ভোগ করতে চাও, তাহলে তোমাকে অবশ্যই গম, ধান, ডালসহ বিভিন্ন রকম শস্য বপণ করতে হবে এবং এক বছর পরে সেটি ভোগ করবে। আর তুমি যদি দশ বছর পরে কোনো সুফল ভোগ করতে চাও, তাহলে তুমি বৃক্ষ রোপণ করো। অর্থাৎ দশ বছর পরে তুমি সেই বৃক্ষ বিক্রি করে তার ফল ভোগ করতে পারবে। আর তুমি যদি একটি জাতিকে গঠন করতে চাও এবং এক শ বছর পরে তার ফল ভোগ করতে চাও, তাহলে তুমি সুন্দর ও আলোকিত মনের মানুষ তৈরি করো।’
মুমিত আর রশিদ বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের মতিউর রহমান ভাই প্রথম আলো বন্ধুসভার মাধ্যমে সেটাই করছেন। আমরাও সেটা করার চেষ্টা করছি।’
‘বন্ধুসভার বন্ধুরা আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।’
উপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের উপদেষ্টা উত্তম রায় বলেন, ‘বন্ধুসভা করি একটা নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য। বহু মানুষের সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হবে। ভবিষ্যতে যেন যেকোনো জায়গায় আমাদের যদি প্রয়োজন হয়, সেই সব সম্পর্ককে যেন কাজে লাগাতে পারি। একটা বিষয় আপনাদের মনে রাখতে হবে, যেকোনো সংগঠনে গেলে আপনারা নেটওয়ার্কিং বাড়াবেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কটাও বাড়াবেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপরে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আরেকটা কথা মাথায় রাখবেন, জীবনে ইগোটা কমাতে হবে। দেখবেন, জীবনে আপনি কোথাও আটকাবেন না।’
ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি মাহমুদা বুশরা বলেন, ‘আমরা সবাই বন্ধু বানাতে চাই, বন্ধুত্ব রক্ষা করতে চাই। বন্ধু বানাতে ও রক্ষা করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সৎ থাকা। বন্ধুত্বের সম্পর্কে সৎ থাকতে হবে। তাহলে সম্পর্ক অনেক দূর পর্যন্ত যাবে।’
এ ছাড়া অনুভূতি ব্যক্ত করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা ও বায়েজিদ ভূঁইয়া জুয়েল। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে যেসব বন্ধুসভার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে একজন করে প্রতিনিধিকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। তাঁরা জানান বন্ধুসভা নিয়ে নিজেদের কথা।
পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ। অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত বন্ধুদের ধন্যবাদ জানান আয়োজনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ আলী ফিরোজ। অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের পেছনে সদস্যসচিব নূর-ই-আলমসহ যাঁরা কাজ করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
আয়োজন সহযোগী হিসেবে ছিল রেজ্যুভা ওয়েলনেস, ওয়ান্ডার উইমেন, বাস নেটওয়ার্ক ও আমা কফি।