ইউনিমেড ইউনিহেলথ-বন্ধুসভা মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক কর্মশালা
মনের যত্নে আনন্দে বাঁচতে হবে
কার মনে কী ঘটে, আমরা জানি না। মন নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সবার থাকে না। তবু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘মন ভালো না থাকলে আবেগ, আচরণ ও চিন্তার সমস্যা হবে। যে বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ নেই, সে বিষয়ে চিন্তা করারও দরকার নেই। সমস্যা এড়িয়ে না গিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। নিজেকে কখনো তুচ্ছ ভাবা যাবে না।’
১৮ আগস্ট রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক এক কর্মশালার আয়োজন করে প্রথম আলো বন্ধুসভা। ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও প্রথম আলো ট্রাস্টের সহযোগিতায় দিনব্যাপী কর্মশালায় সারা দেশের ৮৩ জনসহ শতাধিক বন্ধু অংশ নেন। তাঁদের মনের যত্ন কেন জরুরি, কীভাবে মনের যত্ন নিতে হয়, মাদক ও ইন্টারনেট আসক্তি দূর করা, সুন্দর জীবন ও বেঁচে থাকার আনন্দ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন প্রখ্যাত মনঃশিক্ষাবিদ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।
কর্মশালার প্রথম পর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সিফাত ই সাঈদ বলেন, ‘শরীরে রোগ হলে মানুষ যেভাবে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যায়, মনের অসুখ হলে সেভাবে যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য ব্যতীত স্বাস্থ্য হয় না।’ তিনি আরও জানান, এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ আত্মহত্যা। তাই আগে নিজের যত্ন নিতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, ‘একসময় পাশ্চাত্যে আত্মহত্যা বেশি ছিল। বর্তমানে উন্নয়নশীল বিশ্বের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই প্রবণতা বাড়ছে।’ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বন্ধুসভার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বন্ধুসভার বন্ধুদের মধ্যে দারুণ একটি চিন্তা তৈরি হয়েছে। তাঁরা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও মানসিকভাবে সহায়তা করবেন। সবাইকে সচেতন করবে।’
মনের যত্নে মাদকের আসক্তি মুক্তির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ মোহিত কামাল বলেন, ‘আমাদের পরিচিত কেউ যদি মাদকসেবী হন, তাঁকে দূরে সরিয়ে দেব না। তাঁর কাছে যাব, তাঁর মনের কথা শোনার চেষ্টা করব। যদি একটা ছেলেকেও মাদক থেকে রক্ষা করতে পারি, তাহলে আমরা শতভাগ সফল।’
এই উদ্যোগে কেন বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হওয়া? ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মার বিপণন মহাব্যবস্থাপক সাফায়েত মাহমুদ বলেন, ‘জীবন উপভোগ করা আনন্দের। ফার্মা কোম্পানি হলেও আমাদের কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। সেই জায়গা থেকে বন্ধুসভাকে সঙ্গে নিয়ে তরুণ প্রজন্মের জন্য এ উদ্যোগ।’
মন ভালো রাখার উপায় নিয়ে কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক তাঁর বোনের একটি কথা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, ‘আমার এক বোন ডাক্তার। সে সব সময় বলে, আমাদের ব্রেন একটা জিনিস ধরতে পারে না। সেটা হলো হাসি। তাই বেশি বেশি হাসতে হবে। হাসলে ব্রেন সব পজিটিভ হরমোন নিঃসরণ করে। এতে আমরা ভালো থাকি।’
বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা হাসতে ভুলে যাচ্ছে। অল্পতেই হতাশ হয়ে যাচ্ছে। ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মার বিপণন পরিচালক মুহাম্মদ শামীম আলম খান বলেন, ‘তরুণ-তরুণীদের মধ্যে শেয়ারিং ব্যাপারটা কমে গেছে। দেখানোর প্রবণতা বেড়েছে। প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে অল্পতেই মানসিক বিষণ্নতায় পড়ে যায়। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে মানসিকভাবে ভালো থাকতে হবে।’
আমাদের সবার জীবনে কোনো না কোনো সমস্যা আছে। জীবন একটা যাত্রাপথ। এ যাত্রাপথে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। সেগুলো মোকাবিলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খান।
অংশগ্রহণকারীরাও নিজেদের অনুভূতি জানান। টাঙ্গাইল থেকে আসা এক বন্ধু বলেন, ‘সকালে আসার সময় মাথায় অনেক বোঝা ছিল। কর্মশালার পর এখন মাথা অনেক হালকা লাগছে।’ একজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথাও মাথায় আসত। তবে এখন থেকে এই চিন্তা আর কখনো মাথায় আসবে না।
মানসিক সমস্যা শারীরিক সমস্যার মতোই। এর চিকিৎসা আছে। কারও এ সমস্যা হলে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবে না। খোঁজখবর নিতে হবে, পাশে থাকতে হবে। কথা বলতে হবে। বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।
মডেল ও অভিনেত্রী সোহানা সাবা বলেন, ‘বেঁচে থাকাটা আনন্দের বিষয়। মনের যত্নে আনন্দে বাঁচতে হবে। জীবনকে সর্বোচ্চ উপভোগ করতে হবে।’
প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান বলেন, ‘আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো বর্তমান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পাশের মানুষটি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পাশের মানুষটার জন্য কিছু করা।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা বলেন, ‘জ্বর কিংবা অন্য কোনো কারণে শরীর খারাপ হলে আমরা যেভাবে সচেতন হই, মন খারাপ হলেও একইভাবে সচেতন হতে হবে।’
বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায় বলেন, ‘হতাশ হওয়া যাবে না। প্রতিষ্ঠা পাওয়া বা প্রতিষ্ঠিত হওয়া, যেকোনো বয়সে হতে পারে। এর জন্য ধৈর্য ধরতে হবে।’
কর্মশালা শেষে বন্ধুদের হাতে সনদ তুলে দেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বন্ধুসভার উদ্যোগটিকে এত দিনের সবচেয়ে বড় কাজ উল্লেখ করে বলেন, ‘এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধুসভা আরও বেশি বেশি করবে বলে আমি আশাবাদী।’
কর্মশালায় উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানান বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক। অংশগ্রহণকারীদের একঘেয়েমি দূর করতে সাংস্কৃতিক পর্বও রাখা হয়। নৃত্য ও গান পরিবেশন করেন পারিসা মেহজাবিন ও হৃদয় সৈকত।
বন্ধুসভার পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি জেলায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মশালা আয়োজন করা হবে। এতে সহযোগিতা করবে ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও প্রথম আলো ট্রাস্ট।