আত্মবিশ্বাস নিজেকেই তৈরি করতে হবে

কক্সবাজারে প্রথম আলো বন্ধুসভার দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালা শেষে আলোচক ও প্রশিক্ষকদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা
ছবি: শাকিব হাসান

কেন আপনারা আমাদের চেয়ে বেশি স্মার্ট ও সৃজনশীল? উদ্বোধনী বক্তব্যে কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার আল আসাদ মোহাম্মদ মাহফুজ ইসলাম বন্ধুসভার বন্ধুদের উদ্দেশে এ প্রশ্ন করেন। জবাবে কক্সবাজার সরকারি কলেজ বন্ধুসভার বন্ধু আয়েশা তাসনিম বলেন, ‘কারণ, আমরা জেন–জি।’ এ সময় সবাই করতালি দেন।

আল আসাদ মোহাম্মদ মাহফুজ ইসলাম বলেন, ‘“সৃজনশীল ধ্বংস” বলে একটা কথা আছে। কিছু পরিবর্তন করতে গেলে পুরোনোকে ভেঙে নতুনভাবে তৈরি করতে হবে। দেশ গঠনে বন্ধুসভার তরুণেরা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। কক্সবাজার, চকরিয়া ও মহেশখালীতে বসেও এটা করা সম্ভব। বিশ্বাসটা তৈরি করে যাচ্ছে বন্ধুসভা। বিশ্বাস করতে হবে যে আমি বিশ্বের নাগরিক। তাহলেই আপনারা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারবেন।’

কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন (বাঁ থেকে) বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক, নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ, সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক, জে অ্যান্ড জেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হাসান
ছবি: শাকিব হাসান

১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারে দেড় শতাধিক তরুণকে নিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালার আয়োজন করে বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টের কল্লোল হোটেলের সম্মেলনকক্ষে দিনব্যাপী এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। অংশগ্রহণ করেন কক্সবাজার, কক্সবাজার সরকারি কলেজ, কক্সবাজার সিটি কলেজ, চকরিয়া, মহেশখালী, উত্তরণ মডেল কলেজ ও কক্সবাজার বায়তুশ শারাফ কলেজ বন্ধুসভার বন্ধুরা। সহযোগী হিসেবে ছিল আর্টিকেল নাইনটিন, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও জে অ্যান্ড জেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান হোটেল কল্লোল।

কর্মশালায় নাগরিক সাংবাদিকতা, উপস্থাপনা কৌশল, নেতৃত্ব ও যোগাযোগ এবং পর্যটনে তরুণদের সুযোগ—এ চার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেন বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক, নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ, সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক এবং জে অ্যান্ড জেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হাসান। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কক্সবাজারে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুল কুদ্দুস।

কর্মশালায় কক্সবাজারের সাতটি বন্ধুসভার দেড় শতাধিক তরুণ অংশগ্রহণ করেন
ছবি: শাকিব হাসান

আর্টিকেল নাইনটিন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ে কাজ করে জানিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটির বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম অফিসার শাহনেওয়াজ পাটোয়ারী বলেন, ‘ক্ষতিকর তথ্য সত্য হলেও কখনো কখনো বৃহত্তরে স্বার্থে প্রকাশ করা যাবে না, যেমন এমন কোনো তথ্য, যা নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হতে পারে বা কারও ব্যক্তিজীবনের ক্ষতি হতে পারে।’

উপস্থাপনা কৌশল নিয়ে উপস্থাপক ও অভিনেত্রী মৌসুমী মৌ বলেন, ‘শুরুটা সবার চেয়ে একটু ভিন্ন হতে হবে। উপস্থাপনায় তিনটি জিনিস অবশ্যই থাকা চাই—তথ্য, বিনোদন ও শিক্ষা। উপস্থাপকের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। এটি মৌলিক বিষয়। আত্মবিশ্বাস নিজেকেই তৈরি করতে হবে। সাবলীল বাচনভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। এটা জীবনের সব ক্ষেত্রেই। প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করতে হবে। দেশ-বিদেশে চলমান সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়জ্ঞান থাকতে হবে। উপস্থাপকের সেন্স অব হিউমার ও ব্যক্তিত্ব থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিস্থিতি যা–ই হোক, স্বতঃস্ফূর্ততা থাকতে হবে।’

এ সময় কয়েকজনকে মঞ্চে ডেকে আনেন মৌসুমী মৌ। কর্মশালা থেকে প্রাপ্ত কৌশল ব্যবহার করে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থাপনা করে দেখান।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম অফিসার শাহনেওয়াজ পাটোয়ারী
ছবি: শাকিব হাসান

বন্ধুসভার বন্ধুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরির উদ্দেশ্যেই এ আয়োজন বলে জানান জাফর সাদিক। কর্মশালায় তিনি নাগরিক সাংবাদিকতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। জাফর সাদিক বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে বিশ্বনাগরিক হিসেবে আপনারা প্রত্যেকেই একজন নাগরিক সাংবাদিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি যখন কোনো ঘটনা বা সংবাদ শেয়ার করেন, যা হয়তো তখন পর্যন্ত কোনো সংবাদমাধ্যম প্রকাশ বা প্রচার করেনি, সেটাই নাগরিক সাংবাদিকতা। তবে সেখানে অবশ্যই ঘটনার বিস্তারিত তথ্য থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা, তথ্যটি জনস্বার্থ রক্ষা করছে কি না, তা দেখা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যাহত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য শেয়ার হচ্ছে কি না, তা–ও দেখতে হবে। মোটকথা, নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করতে হবে। মতপ্রকাশ ও বাক্‌স্বাধীনতার অন্যতম মাধ্যম হলো নাগরিক সাংবাদিকতা। তবে আপনার বাক্‌স্বাধীনতা অন্যের বাক্‌স্বাধীনতা হরণ করলে তা নাগরিক সাংবাদিকতার অপব্যবহার হিসেবেই গৃহীত হবে।’

প্রশিক্ষণ কর্মশালার ফাঁকে ফাঁকে কৌতুক ও গানে মাতিয়ে তোলেন ‘মীরাক্কেল’ তারকা কমরউদ্দিন আরমান।

আলোচক ও প্রশিক্ষকরা
ছবি: শাকিব হাসান

পর্যটনে তরুণদের সুযোগের বিষয়ে জে অ্যান্ড জেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হাসান বলেন, জীবন মানে এই নয় যে কেবল নিজের জন্য বেঁচে থাকা। জীবন মানে মানুষের জন্য কিছু করা। সেই লক্ষ্যে পর্যটন খাতে কাজ করে যাচ্ছি। তবে এই খাতে দক্ষ জনবল নেই। আমরা চাই, বন্ধুসভার তরুণেরা এই খাতে আসুক। শিক্ষার্থী অবস্থায় নিজেরা স্বাবলম্বী হোক। আপনারা উদ্যোগ নিলে কক্সবাজারের পর্যটন অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’

ইমরান হাসান উল্লেখ করেন, ‘কক্সবাজারে এলেই শুঁটকির গন্ধ নাকে ঢোকে। আবর্জনায় ভরা পুরো সৈকতনগর। আমরা কেন এটা পরিষ্কার রাখি না? এভাবে থাকলে কেন পর্যটক আসবে? বন্ধুসভার তরুণদের বলব, আপনারা নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যমে এগুলো তুলে ধরুন। সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করুন। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। সদিচ্ছা থাকলে কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা চাই বন্ধুসভার বন্ধুরা এগিয়ে আসুক। তাঁরা উদ্যোক্তা হোক।’

অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সনদ বিতরণ
ছবি: শাকিব হাসান

নেতৃত্ব বিষয়ে আলোচনার শুরুতেই ফরহাদ হোসেন মল্লিক উপস্থিত বন্ধুদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, নেতৃত্ব বলতে কী বোঝায়? এ সময় সাতটি বন্ধুসভার নয়জন প্রতিনিধি মঞ্চে এসে নেতৃত্ব নিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।

ফরহাদ হোসেন মল্লিক বলেন, নেতা হচ্ছেন সেই মানুষ, যিনি সবাইকে অনুপ্রেরণা দিতে পারেন। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে পারেন। কেউ যদি কাজ না জানেন, তাঁকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাও নেতার কাজ। নেতাকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি গড়ে তুলতে হবে। আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো কথা শোনার পর সেটা লিখে রাখতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেতাদের শুনতে হবে, শুধু কথা বললে হবে না। নেতৃত্বদানের গুণাবলি থাকা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। নেতার মধ্যে বৈষম্যহীন মনোভাব থাকতে হবে। সততা, সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।

আরও বক্তব্য দেন আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ অ্যান্ড সাউথ এশিয়ার হেড অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রুবায়েত হোসেন, প্রোগ্রাম অফিসার শায়লা রহমান ইমা, প্রথম আলোর চকরিয়া প্রতিনিধি এস এম হানিফ ও মহেশখালী প্রতিনিধি রুহুল বয়ান।