উন্নয়নকর্মী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চান? প্রস্তুতি ও করণীয়

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

কেমন হবে যদি এমন কোনো কাজকে আপনি পেশা হিসেবে বেছে নেন, যে কাজের কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত মা ও শিশুর মুখে হাসি ফোটানো, দরিদ্র কৃষককে মহাজনের খপ্পর থেকে বের করে স্বাবলম্বী করানো, দুর্যোগ মোকাবিলায় সবার আগে ছুটে যাওয়া, মানুষের ফসলের নিরাপত্তা, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সহনশীলতা অর্জন, ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার আলো দেখানো, নিরাপদ খাওয়ার পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা, সর্বোপরি সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকায় নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা। এগুলোর যেকোনো একটি কাজই হতে পারে আপনার পেশা।

এই পেশাকে বলা হয় উন্নয়নকর্মী। খাতটিতে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে প্রয়োজন এনজিও কার্যক্রম সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা ও যথাযথ প্রস্তুতি।

বাংলাদেশে এনজিও কার্যক্রমের পরিসর অনেক বড়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থার জন্ম যেমন এ দেশে, তেমনি জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার নানাবিদ কার্যক্রমও রয়েছে। অনেক ধরনের দেশি-বিদেশি গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি সংস্থাও কাজ করছে। শিক্ষাজীবন শেষে বা গ্র্যাজুয়েশন করেই অনেকে লক্ষ্য ঠিক করেন, এনজিওতে চাকরি করবেন। তাঁদের জন্য এ লেখা।

সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে জানা
এনজিও প্রতিষ্ঠানের কাজের মূল ক্ষেত্র সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। কেউ যদি এ খাতে কাজ করতে চান, তাহলে সমাজের নিয়ামক ও প্রভাবকগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। আর্থসামাজিক কাঠামো, মানুষের জীবন-জীবিকা, চিন্তাভাবনা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতির ব্যাপারে ধারণা নেওয়া জরুরি। সে জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো যেকোনো এনজিওতে তিন বা ছয় মাসের জন্য ইন্টার্নশিপ করা। ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে ফিল্ড ভিজিটের সুযোগ তৈরি হয়। এ সুযোগ যাঁরা যত ভালোভাবে কাজে লাগাবেন, তাঁরা পরবর্তী সময়ে এ খাতে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে তত বেশি এগিয়ে যাবেন।

এর বাইরেও একাডেমিক ফিল্ড ভিজিট বা বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে যুক্ত হয়েও সমাজের এসব বিষয়ে ধারণা নেওয়া যায়। বর্তমানে উন্নয়ন পেশায় যাঁদের আদর্শ মনে করা হয়, তাঁদের বেশির ভাগই সমাজের মানুষ নিয়ে দীর্ঘদিন সরেজমিন গবেষণায় জড়িত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন
বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কাজের ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু বিষয়ে দক্ষতা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, কর্মসূচির যুক্তিকাঠামো বিশ্লেষণ, বাস্তবায়ন পরিকল্পনা, নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন, সামাজিক মানচিত্র আঁকা, অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ মূল্যায়ন (পিআরএ), উপাত্ত সংগ্রহ উপায়, বিভিন্ন ধরনের গবেষণাপদ্ধতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে এসব বিষয়ে অসংখ্য প্রশিক্ষণ সহজলভ্য। এনজিওতে চাকরি না করলেও এসব বিষয়ে জানা থাকলে যে কারও কর্মজীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেলসহ অন্যান্য অফিস প্রোগ্রামের দক্ষতা অর্জন করে নিতে হবে। কিছু বহুল ব্যবহৃত অফিস অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কেও ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়।

ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, চাকরির খোঁজ, সিভি প্রোফাইলিং
আগ্রহী ব্যক্তিদের অনেকেই পরিকল্পনা ছাড়াই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা আপনার ক্যারিয়ারকে দ্রুত এগিয়ে নিতে পারে। কী ধরনের উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতে চান, সেটি বোঝা জরুরি। পাশাপাশি নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অর্জিত দক্ষতার সমন্বয় রয়েছে কি না, সেটিও নিশ্চিত হতে হবে।

কিছু কাজ রয়েছে গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিছু রয়েছে সামাজিক ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশের বাস্ততবতায় আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সামাজিক উদ্যোক্তা তৈরিকরণ একটি বড় ক্ষেত্র রয়েছে। এ ছাড়া কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ নিয়ে কাজ করার মতো অনেক সংস্থা রয়েছে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে কর্মীকে প্রাথমিক ধারণা নিতে হবে। তাহলে নিজের পড়াশোনা, দক্ষতার সঙ্গে আগ্রহের একটা মেলবন্ধন তৈরি হবে।

চাকরি খোঁজার জন্য বর্তমানে অনলাইন সাইটগুলো বেশ জনপ্রিয়। এর বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিজের প্রোফাইল তৈরি করে সব তথ্য পূরণ করে রাখা দরকার। এতে অনেক সময় অনেক পজিশনে আবেদন না করলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে যথাযথ পদে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পাওয়া যায়। লিংকডইনে প্রোফাইল আপডেট করে রাখলেও বেসরকারি সংস্থায় চাকরির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংস্থায়। কোনো প্রতিষ্ঠানে সিভি জমা দেওয়ার সময় বা সিভি তৈরির সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। সিভিতে গৎবাঁধা কিছু লাইন না লিখে নিজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, আগ্রহ ও পোর্টফোলিও সংক্ষেপে সহজ বাক্যে লেখা উচিত।

আবেদন করি, কিন্তু ডাক পাই না
আগ্রহী ব্যক্তিদের একটি কমন অভিযোগ হলো আবেদন করি, কিন্তু ডাক পাই না। কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য। এটি যাতে না হয়, সে জন্য আবেদনের সময় কিছু বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য রাখা উচিত।
যথা মাধ্যমে আবেদন করার সময় নিজের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিচ্ছেন কি না। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বা খেয়ালের বশে ট্রেনিং, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা বা একাডেমিক বিষয়ে অনেকে পর্যাপ্ত তথ্য পূরণ করেন না।
অনেকে চাকরির পোর্টাল থেকে আবেদন করেন। এ ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তা যেসব তথ্য চান, সেগুলো হয়তো সব কটি জব পোর্টালটিতে থাকে না। তখন আবেদন পূর্ণাঙ্গ হয় না। ভালো হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবপোর্টাল থেকে আবেদন করা। তাহলে আবেদনের অত্যাবশ্যকীয় তথ্যগুলো মিস হওয়ার সুযোগ কম থাকে।
প্রতিটি আবেদনের সময় বিজ্ঞপ্তিতে কাজের যে বিবরণ (জেডি) দেওয়া থাকে, সেটি খুব ভালোভাবে পড়তে হবে।
প্রার্থীর একডেমিক ও অর্জিত দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদগুলোতেই আবেদন করা উচিত।
আবেদনের সঙ্গে আলাদা কভার লেটার যুক্ত করতে হবে।
অনলাইন আবেদনের পাশাপাশি মেইলে আবেদনের সুযোগ থাকলে, সেটিও করতে হবে। যথাযথ কভার লেটারসহ মেইলে আবেদন করলে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পাওয়া সহজ হয়।

জেন্ডার সমতা, সেইফগার্ড, ইনক্লুসিভনেস সম্পর্কে ধারণা
নিরাপদ কর্মপরিবেশ, যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় থেকে সুরক্ষা এবং নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ, মত-পথ–নির্বিশেষে সবার প্রতি বৈষম্যহীন আচরণের ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থাগুলো সতর্ক থাকে। সে জন্য জেন্ডার সমতা, সেইফগার্ড ও ইনক্লুসিভনেসের বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা অর্জন ও ধারণ করা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি
লোকাল সংস্থাগুলোর কাজের ধরন, উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভিন্নতা রয়েছে। বিদেশি সংস্থাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানবিক সংকট মোকাবিলায় জরুরি সাড়াদানে কাজ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে নিজেকে বিশ্ব নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখাটা জরুরি। মানবিক সংকটে দ্রুত সাড়াদান বিষয়ে অসংখ্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ অনলাইনে পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরিপ্রার্থীরা এসব প্রশিক্ষণ করে নিতে পারেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যেকোনো পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আর যেকোনো বিষয়কে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার অভ্যাস তৈরি করাটাও জরুরি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভাষা। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি—যেকোনো একটিতে দক্ষতা থাকলে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলোতে আলাদা সুবিধা পাওয়া যায়।

লেখক: উন্নয়নকর্মী এবং অর্থ সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।