মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে যেন আক্ষেপ না থাকে

মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে যেন আক্ষেপ না থাকে
ছবি: সাইয়ান

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছর পরে এসে অনেকেই নতুন প্রজন্মকে নিয়ে অনেকটা দুঃখ প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রজন্ম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা মনে করছেন, বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অথবা প্রেক্ষাপট থেকে অনেকটা সরে গেছে। বিষয়টি বেদনাদায়ক। কারণ, বাঙালি রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। রক্ত দিয়েছে ভাষার মর্যাদা রাখতে।

কেন তাঁরা এমনটি মনে করছেন?

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য, লেখক ও গবেষক বিভিন্ন লেখা-আলোচনায় উঠে আসছে বর্তমান প্রজন্ম অনেকটাই অসচেতন মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল বিষয়টি নিয়ে তাদের আগ্রহ কম। পারতপক্ষে বিষয়টি নিয়ে এড়িয়ে যেতে পারলেই তারা বাঁচে।

এ বিষয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, গতকাল শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘একাত্তরে গণহত্যা ও পাকিস্তানের বর্বরতা’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন।

সভায় উপস্থিত এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শোনাচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অংশগ্রহণের গল্প। মাত্র ১৬ বছর বয়সে দশম শ্রেণি পড়ুয়া এই ছাত্র দেখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বর হত্যাকাণ্ড। ফুলবাড়িয়া রেললাইনসংলগ্ন বস্তি এলাকাগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনী আগুন ধরিয়ে দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাওয়া সাধারণ মানুষদের গুলি করে মারার দৃশ্য। বলছিলেন, লাশের গন্ধে ঘুমাতে না পেরে, খেতে না পেরে প্রতিশোধ নেওয়ার তাগিদ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার গল্প।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তৌফিকুর রহমান। গল্প বলার শেষ অংশে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার চোখে পানি চলে আসে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মুক্তিমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলে যাওয়ার আক্ষেপে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বলছিলেন, স্বাধীনতার পর নতুন প্রজন্ম সঠিক পথে নেই। মাঝেমধ্যেই তাদের পাকিস্তান–প্রেম দেখা যায়। দেশের মাঠিতে পাকিস্তানের জার্সি পরে খেলা দেখতে চলে যায়। খেলার মাঠে আফ্রিদিকে বিয়ে করতে চায়। ফেসবুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা-বর্বরতা বুঝতে চায় না। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের নির্যাতনের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের শেখাতে হবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের ত্যাগ-সংগ্রাম।

এই অভিযোগের দায় নতুন প্রজন্মের সবাই অবশ্যই নেবে না। তবে কোনো না কোনো অংশের প্রতি এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপটা তো সত্য।

তাহলে আমরা কী করতে পারি?

বিষয়টি নিয়ে হয়তো অনেকেই বলে থাকবে যে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে সরে গেছে তার প্রমাণ কী? এটি ঠিক, অনেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নতুন নতুন বিষয় খুঁজে বের করছেন। তবে এটাও ঠিক, বড় অংশই রয়েছে বাইরে।

যেহেতু নতুন প্রজন্মের দিকে প্রশ্ন উঠেছে, তাই এই প্রজন্মকেই প্রমাণ দিতে হবে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে। যে স্বাধীন দেশটি আমরা পেয়েছি, তার জন্য আমাদেরও কিছু দেওয়ার আছে। আমাদের কাজেকর্মে।

১০ বছর, ২০ বছর—একসময় হারিয়ে যাবেন মুক্তিযোদ্ধারা, তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও। কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস যেন কোনোভাবে হারিয়ে না যায়। সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সে ব্যবস্থা সরকার বা নির্দিষ্ট কারও একার দায়িত্ব নয়।

নতুন প্রজন্মের প্রত্যেককে দায়িত্ব নিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস সংগ্রহ করে, তা আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া। নিজেরা চর্চা করা, যেন যেকোনো বাঙালির জীবনের অংশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে যেন কোনো কিছু কল্পনার সুযোগ না থাকে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বে।

এ ক্ষেত্রে বর্তমান অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। সেখানে আমাদের তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে। যতটা সহজ করে পারা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে।

নতুন প্রজন্ম আরেকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারে। দেশের প্রত্যেক ঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একটি গল্প। এই গল্পগুলো সংগ্রহ করে একত্রিত করা।

যেমনটি পরামর্শ দিয়েছেন ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সব কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপনকারী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি সাংসদ আরমা দত্ত।

আরমা দত্তের পরামর্শ, নতুন প্রজন্ম যেন একাত্তরের প্রেক্ষাপট ধারণ করে বেড়ে ওঠে, সে জন্য আমাদের একাত্তরের গল্প বেশি বেশি জানতে হবে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। এগুলো আমাদের তুলে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে।

*মো. আশিকুজ্জামান আশিক, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়