বন্যার্তদের মুখে হাসি ফুটিয়ে যাচ্ছেন বন্ধুরা

ভৈরব বন্ধুসভার ব্যবস্থাপনায় কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় বন্যাদুর্গত পরিবারের মধ্যে ত্রান বিতরণ করছে বন্ধুরা
ছবি : বন্ধুসভা

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ বাংলাদেশ। প্রতিবছর বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। বন্যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বন্যার ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে প্রাণ গেছে অসংখ্য মানুষের, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলা বাহুল্য। বন্যা কোনো সাময়িক জলাবদ্ধতা নয়, একটি দীর্ঘকালীন দুর্যোগ, কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

এ বছর বৃহত্তর সিলেটের বন্যা স্মরণকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হুট করেই পানি এতটা বেড়ে যাবে কেউ কল্পনা করেনি। ফলে খাবারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে অনেকের পক্ষে ঘর থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ খালি হাতে আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কারও ঘরের চাল পর্যন্ত পানি, কেউ আটকা পড়েছে বাড়ির দোতলায়—নামার সুযোগ নেই। সিলেট বন্ধুসভার বন্ধুদের ঘরের অবস্থা বেগতিক হলেও মনের জোর ছিল প্রবল। প্রথম দিকে বন্ধুরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় কীভাবে, কোথায় ত্রাণ পৌঁছাতে হবে। এরই মধ্যে বন্যার পানি আগ্রাসীভাবে সিলেটের কুমারগাঁও উপকেন্দ্র ডুবিয়ে দেয়, বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরো সিলেট এক অন্ধকার পুরীর রূপ নেয়। নেটওয়ার্কবিহীন অবস্থায় দুশ্চিন্তা জমে বন্ধুদের মনে। অনেক বন্ধুর ঘরে খাবার নেই, যোগাযোগ নেই তাঁদের পরিবারের সঙ্গে। তবুও দমে যায়নি বন্ধুরা। প্রথম আলো ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ সিলেটে পৌঁছামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়েন ত্রাণকার্যে। পরিবারের সদস্যের মতো অসহায় পানিবন্দী প্রতিটি মানুষকে আপনজন মনে করেন বন্ধুরা। তাঁদের জন্য দিনরাত সিলেটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছেন। সহায়তা নিতে এসে ৪৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, ‘বন্যার কারণে কাজকাম করতে পারতেছি না। বাচ্চাকাচ্চা না খেয়ে আছে। এহন পানি কিছুটা কমছে। আপনাদের কাছ থেকে চাল-ডাল পেয়ে অনেক খুশি লাগতেছে।’

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়
ছবি: বন্ধুসভা

বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়ের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে সাতজনের একটি টিম সিলেট পৌঁছায়। ২৪ জুন শুক্রবার সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভূশ্চিগ্রাম, ধোপখাল, ভোলাগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় নৌকায় করে ২০০ জনের হাতে ত্রাণসামগ্রীর প্যাকেট, খাওয়ার স্যালাইন ও ন্যাপকিন দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দী অবস্থায় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। তাঁদের কাছে কোনো সহযোগিতা পৌঁছায়নি। ২৪ জুন ত্রাণ নিয়ে যান ময়মনসিংহ বন্ধুসভার বন্ধুরা। এমন বিপদের দিনে খাদ্যসহায়তা পেয়ে বন্যার্ত অনেকেই খুশিতে কাঁদতে শুরু করেন। কমলপুর পূর্ব পাড়ার বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দী অবস্থায় আছি, এখন পর্যন্ত কেউ কোনো সাহায্য নিয়ে আসেনি।’ রামজীবনপুরের হান্নান মিয়া বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ সাহায্য নিয়ে আসবে তা ভাবিনি।’

গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার রসুলপুরের চরের অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘরবাড়িগুলো অর্ধেক পানির নিচে ডুবে আছে। রান্না করার ব্যবস্থা নেই। বন্যার কারণে দুই দিন থেকে ভুট্টার গুঁড়া ভিজিয়ে খেয়ে জীবন যাপন করছেন রসুলপুর চরের মানুষেরা। সেখানের ৬৩টি বন্যার্ত পরিবারের মধ্যে শুকনা খাবার বিতরণ করেন গাইবান্ধা বন্ধুসভার বন্ধুরা। খাবারের মধ্যে ছিল চিড়া, মুড়ি ও গুড়। জাকির নামের একটি শিশু দুই দিন ধরে রান্না করা খাবার খেতে পারছে না। ঘরে আগে থেকেই থাকা শুকনা খাবার খেয়েই দিন অতিবাহিত করছে। সে জানায়, ‘বন্যার কারণে দুই দিন থেকে রান্না করা খাবার খাই না। ভুট্টার গুঁড়া ভিজিয়ে খেয়ে আছি।’ রসুলপুর চরের সোলেমান আলী বলেন, ‘আমাদের এখানে কোনো ত্রাণ সহযোগিতা এসে পৌঁছায়নি। দুই দিন আগে কিছু লোক এসে সবার নাম নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের আর কোনো খোঁজ নেই। বন্যার পানির ভেতরে অনেক কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।’

বৃহত্তর সিলেটের প্রভাব পড়েছে কিশোরগঞ্জ জেলাতেও। সেখানকার ১০ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে হাওরবেষ্টিত ছয় উপজেলা পুরোপুরি পানির নিচে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় মানুষ। নিজেদের উদ্যোগে ২২ ও ২৭ জুন মিঠামইনের ঢাকী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা।

নৌকা থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভার বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

সিলেট অঞ্চলে ১৭ জুন থেকে দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হলে বন্যার্ত ব্যক্তিদের সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেয় মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা। আর্থিক অনুদান সংগ্রহ শুরু হয়। খাদ্যসামগ্রী কেনার পর ২৩ জুন সকাল ১০টায় মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভার বন্ধুরা রওনা হন সুনামগঞ্জের উদ্দেশে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মুল্লাপাড়া ইউনিয়নের ফাটান বাড়ি ও পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের একাংশের প্রায় ২৫০ পরিবারের কাছে এগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়।

ভৈরব বন্ধুসভার ব্যবস্থাপনায় ১ জুলাই কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় আছানপুর ও নোয়াহাটা গ্রামের বন্যাদুর্গত ৩৫০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়।

প্রতিবারের মতো এবারও কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে বন্যার পানি বেড়েছে। সেখানেও কাজ করে যাচ্ছেন বন্ধুরা। এসব অঞ্চলে সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা, কক্সবাজার বন্ধুসভা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা, মাগুরা বন্ধুসভা, পটিয়া বন্ধুসভাসহ অন্যান্য বন্ধুসভা। সেই অর্থ কেউ নিজেদের উদ্যোগে, আবার কেউ জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে বন্যার্তদের জন্য পাঠিয়েছে।

বন্ধুসভার বন্ধুরা এমনই। নিজেদের বাড়ি তলিয়ে গেছে তবু থেমে নেই তাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়াস, থেমে নেই মানবসেবা।