এই মিতুরাই সাহস জোগান

আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্ত এক নারীর হাতে শুকনো খাবার তুলে দিচ্ছেন মিতু
ছবি: বন্ধুসভা

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে বানের পানি বাড়তে শুরু করে ১০ জুন থেকে। পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে যায় এবং পুরো উপজেলা পানিতে টইটম্বুর। সঙ্গে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। মিতু বুঝতে পারেন, পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এদিকে বানের পানির তীব্র স্রোতে মিনি রেলসেতু ভেঙে যাওয়ায় ঢাকার সঙ্গে মোহনগঞ্জের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাস্তায় কোমরসমান পানি, যান চলাচলও বন্ধ। মানুষের বাড়িঘরে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। সব দেখে অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না বোধ করেন মিতু।

কিন্তু কীভাবে কাজ শুরু করবেন, তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। নিজে এখনো পড়াশোনা করছেন। ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন নাদিরা আক্তার মিতু। জমানো টাকাও খুব বেশি নেই। এগিয়ে আসে একটি প্রতিষ্ঠান। আরও অনেকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন। কখনো নিজের বাড়ি থেকে চাল নিয়ে সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছেন বন্যার্ত মানুষের কাছে; আবার চিড়া, মুড়ি ও মিঠাই কিনে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে দিয়ে আসছেন। ১৮ জুন পাঁচজনের একটি টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মিতু। টিমের বাকিরা ছেলে, মিতু একাই মেয়ে এবং দলটির নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব তার কাঁধেই।

প্রথম দফায় ১৫০টি পরিবারের মধ্যে শুকনা খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। এর পর থেকে প্রতিদিনই কাজ করে যাচ্ছে মিতুর টিম। ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রেও গেছে তারা, অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সুখদেবপুর বানিয়াহারী এসইএসডিপি মডেল উচ্চবিদ্যালয়, ১১ নম্বর পিরোজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, দৌলতপুর মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়পুর দাখিল মাদ্রাসা ও হাছলা উচ্চবিদ্যালয়ে। দলটি এখন পর্যন্ত ৭৫০টি পরিবারের মধ্যে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে।

এসব কাজ করতে গিয়ে মিতু লক্ষ করেন, শুকনা খাবার দিলেও সেগুলো গর্ভবতী নারী ও শিশুদের খাওয়ার উপযোগী নয়। তখন আলাদাভাবে গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ খাবার, শিশুখাদ্য ও স্যানিটারি ন্যাপকিনেরও ব্যবস্থা করে দেন এই স্বেচ্ছাসেবী। পাশাপাশি গবাদিপশুর জন্য খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়। মিতু বলেন, ‘এমন দুর্যোগে এবারই প্রথম কাজ করছি। পাঁচজনের দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছি। এমন অনেক দুর্গম জায়গা রয়েছে, যেখানে যেতে নৌকা লাগে। ত্রাণসহায়তা পৌঁছায় না। আমরা কিছু পথ নৌকা নিয়ে, কোমরসমান পানিতে ভিজে পায়ে হেঁটে সেসব জায়গায় খাদ্যসামগ্রী দিয়ে এসেছি। ত্রাণের প্যাকেট পেয়ে বন্যার্ত মানুষ অনেক খুশি, শিশুদের মুখে ছিল উচ্ছ্বাস।’

নৌকায় করে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন মিতু
ছবি: বন্ধুসভা

২০১৭ সালে প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হন মিতু। বর্তমানে ময়মনসিংহ বন্ধুসভার তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। জানালেন, ‘অসহায় মানুষদের পাশে থাকার, তাঁদের জন্য কাজ করার শুরু বন্ধুসভায় যুক্ত হওয়ার পর থেকে।’ বন্যার শুরু থেকেই নিজ গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জের সমাজ সহিলদেওে-তে আছেন মিতু। বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় পাশে পেয়েছেন মা–বাবাকেও। বাবা নৌকা চালিয়ে ত্রাণ মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিতে সহায়তা করছেন। বিভিন্নভাবে পরামর্শও দিচ্ছেন। আর মা টিমের সবাইকে প্রতি বেলা রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। মানসিকভাবেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তা দেখেই একা নারী হয়েও ছেলেদের টিমের নেতৃত্ব দিতে আরও আত্মবিশ্বাস পান এই সাহসী কন্যা।

ফোনে জানালেন, অসুস্থ হওয়ায় দুই দিন বের হতে পারেননি। সুস্থ হয়ে আবার ত্রাণ দিতে বের হবেন!

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা