গত মাসের ২০ তারিখ থেকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ফেনীর ছয়টি উপজেলাসহ লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ অঞ্চল। গভীর রাতে হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় মানুষেরা ঘর ছাড়েনি বা ছাড়ার সুযোগ পায়নি। দুই সপ্তাহ ধরে ঘরবন্দী হয়ে খাবার-পানিবিহীন এক অনিশ্চিত সময় পার করে লাখ লাখ মানুষ। মানুষের যখন এমন বিপদ, তখন তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদও নিজেদের অনুদান ও ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনীর ১ হাজার ১০০ পরিবার ও শিশুর জন্য প্রায় ৭ লাখ টাকা অর্থমূল্যের ১১ টনের বেশি শুকনা খাবার ও পানি বিতরণ করে। গত ২৩ ও ২৪ আগস্ট জাতীয় পর্ষদের সদস্যরা এসব অঞ্চলে গিয়ে এগুলো বিতরণ করেন।
প্রথম আলো ট্রাস্টের মাধ্যমে বন্যার্তদের জন্য বন্ধুসভার সহায়তা
একই সময়ে স্থানীয় বন্ধুসভাগুলোর মাধ্যমে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ–সহায়তা দিতে শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। শুরুটা হয় ২২ আগস্ট নোয়াখালী থেকে। বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা ১০০ পরিবারের জন্য চাল, ডাল, গুড়, মুড়ি, মোম, দেশলাই, খাবার পানিসহ আরও বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করা থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত করা এবং সেগুলো পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছে দেন নোয়াখালী বন্ধুসভার বন্ধুরা।
এর পর থেকে প্রতিদিনই ট্রাকে করে প্রথম আলো ট্রাস্টের উপহার পৌঁছে যাচ্ছে বন্যাকবলিত ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়। সেখান থেকে উপহার নিয়ে কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায়, আবার কখনো ভ্যানগাড়িতে করে দুর্গম এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন বন্ধুসভার বন্ধুরা। গতকাল সোমবার পর্যন্ত প্রায় আট হাজার পরিবারের কাছে পৌঁছেছে সহায়তা। শুকনা খাবারের পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে রান্না করা খাবারও।
লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী বন্ধুসভার পাশাপাশি এই কার্যক্রমে যুক্ত হন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুরাও। তাঁরা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সদর, নোয়াখালীর সেনবাগ, বেগমগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করেন। বন্ধুরা কোথাও কোথাও বুকসমান পানিতে হেঁটে হেঁটে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন খাদ্যসামগ্রী।
নিজ উদ্যোগ ও যৌথভাবে বন্ধুসভার সহায়তা
সাতক্ষীরা বন্ধুসভার বন্ধুরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের জেলেখালী ও হরিণখোলার ১৫০ নারী ও শিশুর মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেন। এই কার্যক্রমে সহযোগিতা করেন ডা. সুশান্ত ঘোষ।
হরিণখোলা গ্রামের মৎস্যজীবী সন্তোষ মণ্ডলের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা পম্পা মণ্ডল (২২)। স্যানিটারি ন্যাপকিন পেয়ে তিনি খুবই খুশি। তিনি জানান, অনেকে তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। তবে কেউ নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করেনি। এই উদ্যোগ নেওয়ায় সাতক্ষীরা বন্ধুসভাকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
রাঙ্গুনিয়া বন্ধুসভার নিজস্ব উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার ৬০টি পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার খুঁজে বন্ধুসভার বন্ধুরা এসব পরিবারের সদস্যদের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধুরাও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ফেনী ও নোয়াখালীর বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় হাজারো মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা নিয়ে যান। ড্যাফোডিল বন্ধুসভাও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মিলে মানবিক এই কার্যক্রমে অংশ নেয়। একইভাবে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে যৌথভাবে ত্রাণসহায়তা দেন নোবিপ্রবি বন্ধুসভার বন্ধুরা।
এ ছাড়া সিলেট, দিনাজপুর, গাজীপুর, কসবাসহ সারা দেশের বিভিন্ন বন্ধুসভা বন্যার্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে সেগুলো স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মিলে দুর্গম এলাকায় পৌঁছে দিয়েছে।
জাতীয় পর্ষদের মাধ্যমে ত্রাণসহায়তা পৌঁছানো
বন্যার্তদের জন্য তহবিল গঠন করে ঝিনাইদহ বন্ধুসভার বন্ধুরা সংগ্রহ করেন ৪০ হাজার ৭০০ টাকা। এই অর্থ বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদে পাঠিয়েছেন তাঁরা। একইভাবে টাঙ্গাইল, দিনাজপুর বন্ধুসভাও তাদের সংগ্রহকৃত অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছে। এগুলো বানভাসি মানুষের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য ব্যয় করা হবে। এ ছাড়া গ্রামীণ ডানোনের পক্ষ থেকে দুই হাজার প্যাকেট বিস্কুট ও পাউডার জুস এবং ফ্যাশন হাউস লা রিভের পক্ষ থেকে ৫ হাজার ৪০০টি নারী, পুরুষ ও শিশুদের নতুন পোশাকও ফেনী অঞ্চলে পৌঁছে দেবে জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।
এ বিষয়ে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও বন্ধুসভা থেকে প্রাপ্ত উপহারসামগ্রী ও তহবিল কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে সুষ্ঠু বণ্টন সম্পন্ন হবে, যা আমরা ইতিমধ্যে শুরু করেছি।’
বানভাসি মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য চিকিৎসা
৬ সেপ্টেম্বর ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মো. ছাবের সরকারি মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোগে দিনব্যাপী মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হবে। যেখানে অন্তত এক হাজার মানুষ ও এক হাজার গবাদিপশুর জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। গবাদিপশুর চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করেছে বশেমুরকৃবি বন্ধুসভা। মানুষের চিকিৎসার জন্য থাকছেন বন্ধুসভা ও হিউম্যান এইড ফাউন্ডেশনের একদল চিকিৎসক। তাঁরা স্বেচ্ছাসেবায় চিকিৎসা দেবেন। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বিনা মূল্যে ওষুধও দেওয়া হবে। সার্বিক সহযোগিতায় থাকবে ফেনী বন্ধুসভা।