মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মহাকাব্যিক অধ্যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ডিসেম্বর মাস অনেক ধরনের তাৎপর্য বহন করে। ডিসেম্বরে এসেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতার বিজয় অনিবার্য।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহর: একটি জাতির পুনর্জন্ম’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ময়মনসিংহ বন্ধুসভা। ৪ ডিসেম্বর বিকেলে ময়মনসিংহ মহানগরের থানাঘাটের মুক্তিযোদ্ধা বধ্যভূমিতে এটি অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরিওয়ালা, জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল। তিনি ১৮ বছর বয়সে তারুণ্য ও একবুক সাহস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন যুদ্ধ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের কথা, ডিসেম্বরের রণকৌশলসহ ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় নিয়ে সারগর্ভ আলোচনা করেন জাতির এই অকুতোভয় বীর। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকের রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা, বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপট এবং একটি স্বাধীন জাতির জন্মের রোমহর্ষ মুহূর্তগুলো তুলে ধরেন তিনি।
সভাপতি মোহাম্মদ খালিদ হাসানের সঞ্চালনায় সভায় মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়; প্রকৃত ইতিহাস জানতে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি বক্তব্য অমূল্য সম্পদ। নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার প্রকৃত মূল্য বুঝতে হলে এ ধরনের আয়োজন আরও বেশি প্রয়োজন।’
মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমুন্নত রাখতে বন্ধুদের ‘ওয়ানম্যান আর্মি’ হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিমল পাল বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়া, জানা এবং গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা জরুরি। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা শোনা ও সংরক্ষণ করা নতুনদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করবে। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রতিরোধ করে সত্য প্রচার করা প্রয়োজন। বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন, সাংস্কৃতিক চর্চা ও মানবিক কাজে অংশগ্রহণ তরুণদের দায়িত্ববোধ বাড়ায়। স্বাধীনতার মূল্য ও ত্যাগকে হৃদয়ে ধারণ করাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার প্রধান পথ।’
বন্ধুসভার ম্যাগাজিন সম্পাদক মুনমুন আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক বিষয়ে এমন হৃদয়ছোঁয়া আলোচনা প্রত্যক্ষ করা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। বন্ধুদের মুখে উৎসাহ, প্রশ্ন ও কৌতূহল দেখে মনে হয়েছে, আমরা সঠিক পথে হাঁটছি। বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস জানুক, দেশকে ভালোবাসুক—এই বিশ্বাস থেকেই এমন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকা আমাদের দায়িত্ব। বন্ধুসভার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা আগামী দিনে স্বাধীনতার চেতনা আরও শক্ত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করবে।’
সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্বের শিকড়। তরুণ প্রজন্ম যেন সত্যিকারের ইতিহাস জানতে পারে এবং স্বাধীনতার মূল্য উপলব্ধি করতে পারে—এটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শোনার সুযোগ আজকের যুবকদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আমরা চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশপ্রেম, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যাক। বন্ধুসভার এই আয়োজন সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা।’
আলোচনা শেষে ময়মনসিংহ বন্ধুসভার নিয়মিত প্রকাশনা সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘প্রত্যুষ’–এর চারটি সংখ্যা মুক্তিযোদ্ধা বিমল পালকে উপহার দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক উম্মে সালমা, সাংগঠনিক সম্পাদক রাবিয়াতুল বুশরা, বন্ধু অনিক চন্দ্র, বোরহান উদ্দিন, আরিয়ান ইয়াছিন, ফারহান তানভীর, জেবিন আহমেদসহ অন্যরা।
সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা