২২ থেকে ২৪—কিছুই বদলায়নি সিলেটবাসীর জন্য। বাইশের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছে, তখন আবারও সিলেট সদরসহ আশপাশের প্রায় সব উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। গত মাসের শেষভাগে সিলেটে কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে সিলেটসহ আশপাশের সব উপজেলা উজান থেকে নেমে আসা বানের জলে ভেসে যায়। বিশেষ করে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। শহরের মানুষেরও ভোগান্তির শেষ ছিল না। অতিপ্লাবিত জায়গায় নৌকাই ছিল অন্যতম বাহন।
বরাবরের মতো এ বছরও প্রবল বন্যার কবলে পড়া সিলেটবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। তাদের ব্যবস্থাপনায় গত ২৫ জুন সকাল থেকেই শুরু হয়ে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শেষ হয় ২৮ জুন। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শিমুলতলা গুচ্ছগ্রামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৫০টি পরিবার, গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের মানাউরা কান্দিবাড়ী গ্রামে বানভাসি ৫০টি পরিবার, সদর উপজেলায় ১০০টি ও ফেঞ্চুগঞ্জে ৬০টি পরিবারের মধ্যে ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেন সিলেট বন্ধুসভার বন্ধুরা।
প্রথম দিন ত্রাণ নিয়ে বন্ধুদের গন্তব্য ছিল কোম্পানীগঞ্জের শিমুলতলা গুচ্ছগ্রাম। প্রথমে লেগুনায় ও পরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ওই গ্রামে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছান তাঁরা। ’২২ সালের বন্যায়ও ওই এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছিল; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে খুব একটা কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার ত্রাণ বিতরণ শেষে গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে বন্যার ঢেউয়ে ভেঙে যাওয়া টঙে বসে কথা বলার সুযোগ হয়। ত্রাণ পেয়ে তাঁরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আগেরবার আমরা অনেক জায়গা থেকে সহায়তা পেয়েছি; কিন্তু এবার তেমন কেউ সহায়তা করেনি। আপনারা আমাদের জন্য সহায়তা নিয়ে এসেছেন, আমরা খুব খুশি।’
এ সময় এক বৃদ্ধ নারী এগিয়ে আসেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁর জন্য ত্রাণের বস্তা নিয়ে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য কাজ। তখন বন্ধুসভার এক বন্ধু বস্তাটি এগিয়ে দিয়ে আসেন। বৃদ্ধ ওই নারী বলেন, ‘বাবা ত্রাণ দিছ খুব খুশি অইছি। তোমরার লাগি দোয়া করি; কিন্তু আমরা আর ত্রাণ চাই না। আমার ঘরটা একটু উঁচা করি দেও।’ আরও কয়েকজনও একই দাবি করেন।
স্থানীয় সমাজকর্মী আব্দুর রউফের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে প্রায় প্রতিবছরই বন্যার পানি ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়ে। তাঁরা আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েও যেন পাচ্ছেন না।
দ্বিতীয় দিন বন্ধুরা গোয়াইনঘাটের নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের মানাউড়া গ্রামের বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে যান। সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এক বন্ধু বলেন, ‘লেগুনায় করে যাওয়ার সময় রাস্তার দিকে তাকিয়ে বন্যার ভয়াবহতা ক্ষানিকটা আঁচ করতে পারছিলাম। তারপরও আমাদের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল, একটু এগোনোর পরই গাড়িটি একটি গর্তে আটকে যায়। অনেক চেষ্টা করে গাড়ির দেবে যাওয়া চাকাটি তুলি। গ্রামের কাছাকাছি যাওয়ার পর জানা গেল গাড়ি নিয়ে গ্রামে যাওয়া যাবে না। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে যেতে হবে। কী আর করা, ছোট ছোট ৫টি নৌকায় ত্রাণের বস্তা নিয়ে গ্রামটিতে পৌঁছালাম। গ্রামটি দেখে মনে হলো ছোট একটা দ্বীপ, চারদিকে শুধু পানি।’
বন্ধুদের আসার খবর পেয়ে বেশ কয়েকটি নৌকায় করে মানুষজন আসেন। তাঁদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের পর ফেরার পথে ফুলবানু বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দেখিয়ে বলেন, ‘আফালে (বন্যার পানির ঢেউ) আমার ঘরের বেড়া ভাইঙা লইয়া গেছে গা। বৃষ্টি আইলে ঘরো থাকন যার না। পেট ভইরাই কুনতা খাই না অত দিন। ত্রাণ পাইয়া অনেক খুশি অইছি।’
তৃতীয় দিন সদর উপজেলার ঝাংগাইল ও সারদা হল প্রাঙ্গণে ত্রাণ বিতরণ করেন বন্ধুরা। চতুর্থ ও শেষ দিন যান ফেঞ্চুগঞ্জে। সেখানে সদর ও কটালপুর গ্রামে বন্যার্ত মানুষদের ত্রাণ দেওয়া হয়। ১২টি বেদে পরিবার উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার অফিসে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে গিয়ে প্রথমে তাঁদের খুঁজে বের করেন বন্ধুরা। তাঁদের অস্থায়ী ঘরগুলো নদীর পানিতে প্রায় ডুবে ছিল। একজনকে ‘পানি যখন উঠছিল তখন কোথায় ছিলেন?’ জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে সামান্য কিছু বাজার করেছিলাম, কিন্তু ভালোমতো রান্না করে খেতেও পারিনি। যেই খেতে বসেছি, গাঙের পানি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোনোভাবে টানাটুনি করে বাচ্চা নিয়ে এসে এখানে উঠেছি। কোনো দিন খেতে পারি, কোনো দিন খেতেও পারি না। ব্যবসাও নাই, খুব কষ্টে দিন যায়। এই আপনারা দিলেন কয়দিন খেতে পারব।’
বেদেপল্লির পর কটালপুর গ্রামে স্থানীয় কয়েকজনের সহায়তায় ত্রাণ বিতরণ শেষে ফিরে আসেন বন্ধুরা। ত্রাণ পেয়ে মানুষের মধ্যে আনন্দ থাকলেও তাঁরা প্রতিবছর এই বন্যা থেকে মুক্তি চান।
সভাপতি, সিলেট বন্ধুসভা