‘আলোকিত হতে হলে বেশি বেশি বই পড়তে হবে’

বন্ধুদের জীবনের গল্প শোনান একুশে পদকপ্রাপ্ত ‘দই বেচে বই বিতরণ করা’ চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হকছবি: বন্ধুসভা

‘একটি দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমে মানুষকে আলোকিত হতে হবে। আলোকিত হতে হলে বেশি বেশি বই পড়তে হবে, জ্ঞানচর্চা করতে হবে। আর বেশি বেশি বই পড়তে হলে আমাদের যেতে হবে পাঠাগারে। কেননা, একটি পাঠাগারে নানা ধরনের বই থাকে। জ্ঞানের পরিধি থাকে অপরিসীম। প্রতিটি গ্রামে একটি আদর্শমানের পাঠাগার থাকলে জ্ঞানচর্চার সুযোগ পাবে সবাই। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তরুণ ও যুবসমাজকে বেশি বেশি বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে।’

১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুদের এ উপদেশ দেন সমাজসেবায় অবদান রাখায় বেসামরিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদকপ্রাপ্ত ‘দই বেচে বই বিতরণ করা’ চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক। তিনি ভোলাহাট উপজেলার মুসরিভূজা বটতলা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ফেরি করে দই বিক্রি করতেন। সেই আয়ে সংসার চালানোর পর উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে বই কিনে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করেন। গরিব শিক্ষার্থীদের অর্থ সহায়তাও দিতেন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত জিয়াউল হকের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

বন্ধুরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা দেন। এ ছাড়া বাড়ির আঙিনায় রোপণের জন্য উপহার দেওয়া হয় একটি বকুল ফুলের গাছ। জিয়াউল হক বন্ধুদের তাঁর প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারটি ঘুরিয়ে দেখান। পাঠাগারে ছিল বইয়ের সমাহার। নানা বিষয়ের বই। কথায় কথায় জিয়াউল হক বন্ধুদের বলেন, তাঁর ছোট্ট এ পাঠাগারে বই রাখার জায়গা না থাকায় আরও অনেক বই তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজের পাঠাগারে রেখে এসেছেন।

জীবনের গল্প শোনাতে গিয়ে জিয়াউল হক জানান, ১৯৫৫ সালে তিনি পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গরুর দুধ দোহন করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা বই কেনার জন্য দেড় টাকাও দিতে পারেননি। এরপর উচ্চবিদ্যালয়েও ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠেনি আর। এরপর বাবার সংগ্রহ করা দুধ দিয়ে দই তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। দু-তিন বছর পর কিছু টাকা জমা হয় জিয়াউল হকের হাতে। তখন তাঁর চিন্তা হয়, যারা তাঁর মতো টাকার অভাবে বই কিনতে না পেরে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়তে পারে, তাদের তিনি এই টাকা দিয়ে বই কিনে দেবেন। তবেই তাঁর বিদ্যালয়ে পড়তে না পারার বেদনা লাঘব হবে। এভাবে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলি শুরু করেন তিনি। যত দিন পর্যন্ত সরকার বই বিনা মূল্যে দেওয়া শুরু করেনি, তত দিন পর্যন্ত তিনি বই দিতে থাকেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের বই দিতে থাকেন জিয়াউল। তাঁর দেওয়া বই পড়ে ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে অনেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে চাকরি করছেন। শুধু তা–ই নয়, দই বিক্রি করা টাকায় বইয়ের ভান্ডার গড়ে তোলেন। ১৯৬৯ সালে নিজের বাড়ির একটি ঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ পাঠাগার’। এ পাঠাগারে এখন ১৪ হাজার বই আছে বলে জানান তিনি। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বইও আছে। সব বই রাখার স্থান না হওয়ায় সেই বইগুলো আছে পাশের মুসরিভূজা ইউসুফ আলী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠাগারে।

বাড়ির আঙিনায় রোপণের জন্য উপহার দেওয়া হয় একটি বকুল ফুলের গাছ
ছবি: বন্ধুসভা

জিয়াউল হক বলেন, ‘শুধু পাঠ্যবই পড়ে ছাত্রদের জ্ঞান অর্জন হবে না মনে করেই আমি নিজের নামে সাধারণ পাঠাগার স্থাপন করেছি। ১৯৯৩ বা তারও পরে ভোরের কাগজে “দইওয়ালার বই ভান্ডার” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের তৎকালীন কর্মকর্তা ও বর্তমানের টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান আমার বাড়িতে এসে পাঠাগারের জন্য এক লাখ টাকা অনুদান দিলে পাঠাগার সমৃদ্ধ হয়। পরে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রবাসে থাকা মানুষজন, দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষজন আমাকে আর্থিক সহায়তা দিতে থাকেন। আমি কলেজ পর্যায়ের গরিব ছাত্রদের মধ্যে বই বিলির পাশাপাশি গরিব, অসহায় মানুষ ও এতিমদের সাহায্য করতে সমাজসেবামূলক কাজে নেমে পড়ি। এ জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছি। তবে একুশে পদক কখনো পাব ভাবিনি।’

এ সময় বন্ধুদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার সভাপতি আরাফাত মিলেনিয়াম, সহসভাপতি মো. আসাদুজ্জামান, জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক আলীউজ্জামান নূর, বন্ধু মাসরুফা খাতুন, নাজিফা আনজুম, মো. মাহমুদ, ইস্তিয়াক আলী, মো. সজীব, মামুন হোসেন, রাসেল মাহমুদ, মাহমুদ হাসানসহ অন্যরা।

জেন্ডার ও সমতাবিষয়ক সম্পাদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা